এদিকে রপ্তানিযোগ্য আম নির্বাচনে সর্বোচ্চ সতকর্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তারা দৃঢ়তার সাথে বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে আম রপ্তানিতে এ বছর ননকমপ্লায়ান্সকে শুন্যের কোটায় রাখতে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।
ভবিষ্যতের আমের বাজারেই কেবল নয়, এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে দেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্যান্য সবজি রপ্তানিরও ভবিষ্যত। আর সে কারণে আম রপ্তানি ক্ষেত্রে সামান্য ছাড় দিতেও রাজি নয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর।
অন্যদিকে রপ্তানিকারক ও উৎপাদকরা বলছেন, এ বছর সরকার একটু বেশিই কড়াকড়ি করছে। ফলে অনেক আমচাষী ও রপ্তানিকারক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন।
এসব বিষয়ে বাংলানিউজের কথা হয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আনোয়ার হোসেন খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, রপ্তানি বাজারকে সামান্য ক্ষতির মুখে পড়তে না দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সতকর্কতা ও নজরদারি নিশ্চিত করেই রপ্তানির জন্য প্রতিটি আম নির্বাচন করা হচ্ছে। বাগান থেকে সতর্ক বাছাইয়ের মাধ্যমে আম সংগ্রহ করে তা কাভার্ড ভ্যানে সিলগালা করে প্রত্যয়নপত্রসহ পাঠানো হচ্ছে ঢাকায়। রাজধানীর শ্যামপুরে সেন্ট্রাল প্যাকিং সেন্টারে সে আম বিশেষ গ্রেডিং-শর্টিং হচ্ছে। সে আম খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ দফতরের কোয়ারান্টাইনে রেখে সবশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সিলগালা করে পাঠানো হচ্ছে কার্গোভিলেজে। সেখানে নিযুক্তরা সনদ দেখে সিলগালা খুলে কার্গোতে তুলে দিচ্ছে রপ্তানিযোগ্য আম।
সরকারের এই সতর্ক প্রক্রিয়ায় রপ্তানির জন্য উৎপাদিত আমের বেশিরভাগই বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনকারীর পড়েছেন বিপাকে। সাধারণের চেয়ে কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি খরচে আম উৎপাদন করে তারা এখন রপ্তানি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
উৎপাদনকারীরা মনে করছেন সরকারের আমলাতন্ত্রে পড়ে তারা এ বছর বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন। যা চাপাইনবাবগঞ্জে আম উৎপাদনে স্থায়ী প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করছেন তারা। উৎপাদকরা জানিয়েছেন তারা প্রায় ১০ হাজার টন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করেছেন। অথচ রপ্তানিকারকরা তাদের আম বাগানেই বাতিল করে দিচ্ছেন। আর বাগান থেকে যা সংগ্রহ করা হচ্ছে তারও দুই-তৃতীয়াংশ বাতিল করা হচ্ছে কোয়ারান্টাইনে। কৃষি দফতরের পরামর্শ মেনে ব্যাগিং পদ্ধতিতে পোকার আক্রমনমুক্ত আম উৎপাদন করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
বাংলানিউজের কথা হয় চাপাইনবাগঞ্জের শিবগঞ্জের আম চাষী ইসমাইল খান শামীমের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করে রপ্তানি করে আসছেন। তার বাগানের আম নিয়ে সুনামও রয়েছে। কিন্তু কোনও কারণ ছাড়াই এ বছর তার আমগুলো বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে কোয়ারেন্টাইন থেকে।
আক্ষেপের সুরে শামীম বলেন, এই কোয়ারান্টাইন এখন আমাদের কাছে জুজু হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাগান থেকে যে আম বাছাই করে পাঠানো হচ্ছে তার মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ টিকছে বাকিটা বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ শতভাগ বিষমুক্ত, পোকার আক্রমনমুক্ত আম উৎপাদন করেই ঢাকায় পাঠাচ্ছি।
তিনি বলেন, স্থানীয় কৃষি দফতরের কর্মকর্তারা সার্টিফিকেট দিয়ে ঢাকায় পাঠাচ্ছেন, তাদের সে সার্টিফিকেটও বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে আম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে।
কথা হচ্ছিলো এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলামের সঙ্গেও। তিনিও এত বেশি হারে আম বাতিল হয়ে যাওয়ায় হতাশ। বলছিলেন, আমরাও চাই একটি আমও যেনো পোকায় আক্রান্ত কিংবা বিষযুক্ত না হয়। কিন্তু তাই বলে প্রতি ১০ কেজি আমের মধ্যে মাত্র তিন কেজি আম নেওয়া হলে আর সাত কেজিই বাতিল করলে রপ্তানিকারক ও উৎপাদক উভয়ই বড় ক্ষতিতে পড়বে।
কোয়ারান্টাইনে যে পরিমান আম বাতিল হয়ে যাচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন এই রপ্তানিকারক বলেন, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের আমের একটা চাহিদা তৈরি হয়েছে। সেটা আমরা এবছর ধরতে না পারলে ক্রেতা আবারও ভারতীয় আমের দিকে ঝুঁকবে। তাতেও কিন্তু দেশের ক্ষতি হবে।
তবে আনোয়ার হোসেন খান বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে এবছর বাংলাদেশের আম নিতে চেয়েছে। তাদের শর্ত মেনে নন-কমপ্লায়ান্সকে জিরোর কোটায় নামিয়ে তবেই আমরা আম পাঠাচ্ছি।
তিনি বলেন, স্রেফ ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করলেই তা রপ্তানি যোগ্য হয়ে যায় না। পুরো আম উৎপাদন সাইকেলটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার যারা তারাও যে আম উৎপাদনে পুরোপুরি মান নিশ্চিত করেছে এমনটা নয়। আর সে কারণেই বাদ পড়ছে।
হুজুগে মেতে অনেকেই এখন রপ্তানি করতে চান। সবাই যদি রপ্তানি করবেন তাহলে দেশের বাজারে আম আসবে কোথা থেকে? প্রশ্ন করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, যারা যত কথাই বলুন না কেনো সরকার এবার কোনওভাবেই ছাড় দেবে না।
একটু বেশিই কড়াকড়ি হচ্ছে? উৎপাদক-রপ্তানিকারকদের এই অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, হোক না একটু কড়াকড়ি। এতে আমরা ইউরোপে আমের বাজারটিতে প্রবেশ করতে পারবো। যা দেশের জন্যই ভালো হবে।
উৎপাদক শামীম বলেন, যারা কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার তাদের জন্য সরকারকে সুদৃষ্টি দিতেই হবে। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমরা যে আম উৎপাদন করেছি তা শতভাগ বিষমুক্ত, পোকামুক্ত ও ফ্রুট ফ্লাইমুক্ত। আর যে দাগের কথা বলা হচ্ছে তা এবারের পদ্ধতিগত কারণে হচ্ছে। তিনি বলেন, আগের বছরগুলোতে রপ্তানির জন্য আম বাগান থেকে প্যাকেট করা হতো। কিন্তু এবার প্লাস্টিকের ঝুড়িতে প্রথম নেওয়া হচ্ছে রাজধানীতে। সেখানে গ্রেডিং-শর্টিং-প্যাকিং হচ্ছে। এই ঝুড়িতে নেওয়ার কারণে আমে দাগ পড়ে যাচ্ছে ফলে আমাদের আম অকারণে বাতিল করা হচ্ছে।
মান সম্মত আম দেশের বাজারেও চলতে পারে। দেশের সুপারশপগুলো যাতে এসব আম নেয় সে লক্ষ্যেও চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন আনোয়ার হোসেন খান। তিনি বলেন, আম উৎপাদন হয় দেশের জন্য। রপ্তানি করা সম্প্রতি শুরু হয়েছে। আমরা ধীরে ধীরে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করবো। এখনই অনেক আম পাঠিয়ে কোনও বিপদ ডেকে আনতে চাই না।
তবে দেশের বাজারে আম বিক্রি মোটেই লাভজনক হবে না বলে মনে করছেন এই উৎপাদকরা। তারা বলেন, কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িংয়ের অংশ হিসেবে বিষমুক্ত, পোকামুক্ত আম বিশেষ ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদন করতে কেজি প্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি খরচ হয়। সুতরাং একই বাজারে দুই ধরনের দামের আম বিক্রি করা কঠিন।
এ বিষয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, ব্যাগিং কোনও পরীক্ষিত ও আন্তর্জাতিকবাজারে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয়। সুতরাং ব্যাগিং হলেই আম ভালো হবে এমন নয়। তবে এটা সত্য ব্যাগিংয়ে আম দেখতে সুন্দর হয়। ফ্রুট ফ্লাই বসতে পারে না বলে দাগহীন থাকে।
একটু বেশি দাম হলেও দেশের বাজারে এসব আম বিক্রি করা সম্ভব বলেই মনে করেন এই সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এতে দেশের মানুষও একটু বেশি দাম দিয়ে হলেও ভালো আম খেতে পারবে সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৯ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৭
এমএমকে