ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সিদ্ধ ডিমে বাচ্চা, মুনাফার মচ্ছবে সিপি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
সিদ্ধ ডিমে বাচ্চা, মুনাফার মচ্ছবে সিপি সিপি’র ডিম সিদ্ধ করে পাওয়া গেলো বাচ্চা। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: সুপার চেইন শপ জিনিয়াস এর বারিধারা আউটলেট থেকে ১৩৫ টাকায় এক ডজন ডিম কিনেছিলেন এক ক্রেতা (ইনভয়েস নাম্বার pos#246832)। বাড়িতে নিয়ে সিদ্ধ করার পর আঁতকে ওঠেন রীতিমতো। ১২টার মধ্যে ৪টিতেই বাচ্চা!

জিনিয়াসে বিক্রি হলেও ডিমগুলো সরবরাহ করেছে সিপি। থাইল্যান্ড ভিত্তিক বহুজাতিক এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ভোক্তা ঠকানো ও দেশের পোলট্রি বাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগ বেশ পুরনো।

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা এ কোম্পানি এরই মধ্যে ডিম, মুরগি, মুরগির বাচ্চা, খাদ্য ও ওষুধসহ পোল্ট্রি শিল্পের সামগ্রিক বাজারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। জিনিয়াস সুপারশপে সিপি’র ডিম।                                          ছবি: বাংলানিউজঢাকা ও চট্টগ্রাম মিলিয়ে শতাধিক ফুড আউটলেট, ৬০টি সুপার ও চেইন শপে পণ্য সরবরাহ করছে তারা। এসব পণ্যের মধ্যে লেয়ার মুরগি আর হাঁসের ডিমও রয়েছে।  

১৯৭৮ সালে দক্ষিণ থাইল্যান্ডে ব্যবসা শুরু করা সিপি ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশেও ব্যবসা শুরু করে কিচেন অব বাংলাদেশ স্লোগান সামনে রেখে।

কোম্পানির শীর্ষ দুই পদের কোনটিতেই বাংলাদেশি নেই। মি. সুকাত শান্তিপদ প্রেসিডেন্ট ও প্রিদা চুনং ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উপরন্তু বাংলাদেশের একটি কোম্পানির সঙ্গে ৫১:৪৯ শেয়ারে ব্যবসা শুরু করলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে তারা বাংলাদেশি পার্টনারকে সরিয়ে দিয়ে শতভাগ মালিকানা নিজেদের নামে নিয়ে নিয়েছে।

তাদের ফুডশপগুলোতে ক্রেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ভ্যাট চালান না দেওয়ার এন্তার অভিযোগও আছে। জিনিয়াস সুপারশপ থেকে সিপি’র ডিম কেনার রশিদ।  ছবি: বাংলানিউজ
 
সারাদেশে তিন শতাধিক ফুড আউটলেট রয়েছে তাদের। ঢাকা শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে, এমনকি অলিতে-গলিতে চোখে পড়ে সিপি’র আউটলেট। ভোক্তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে  ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এমনই তিনটি আউটলেটে অভিযান চালায় মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।  
 
অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সিপি’র তথ্য-উপাত্ত ও হিসাব সংক্রান্ত কাগজপত্র জব্দ করে।   তখনই ধরা পড়ে, ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়াই জাঁকিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে সিপি।

ঢাকার সাভার ও গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং চট্টগ্রামে ফিড মিল ছাড়াও হ্যাচারি এবং ব্রয়লার ও লেয়ার ফার্ম আছে সিপি’র।

উৎপাদন ক্ষমতা অধিক হওয়ায় ইচ্ছেমতো পোলট্রি ফিড ও ফুডের মূল্য নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে তারা। তাদের একচেটিয়া আধিপত্যে এরইমধ্যে দেশের বহু ক্ষুদ্র খামারি পথে বসে গেছে বলে অভিযোগ ‍আছে।  

সরকারের সঙ্গে সিপি’র ব্রয়লার মুরগি পালন ও বাজারজাতকরণের চুক্তি নেই বলেও দাবি দেশি খামারিদের।  

দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে 'পোল্ট্রি জায়ান্ট' হিসেবে পরিচিত এ কোম্পানির বিরুদ্ধে ২০১৩ সালেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের স্থানীয় উদ্যোক্তারা। কৃত্রিম উপায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে ভিয়েতনাম সরকার সিপি’র বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু করে।

অবৈধভাবে সিপি’র ব্রয়লার মুরগি পালন ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের মে মাসে মানববন্ধন করে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার প্রায় দেড় হাজার খামারি।

তবে সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পোল্ট্রির সব সেক্টরে একচেটিয়া ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে সিপি। একদিন বয়সী বাচ্চা উৎপাদন থেকে শুরু করে ফিড ও ফিডের প্রিমিং তৈরি, ডিম ও মাংস উৎপাদন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পোল্ট্রি ওষুধ ও ভ্যাকসিন আমদানি করে বাজারজাত শুরু করে তারা।

দেশি খামারগুলোকে বসিয়ে দিতে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বনেরও অভিযোগ ‍আছে সিপি’র বিরুদ্ধে। বিপুল পুঁজির মালিক হওয়ায় হুট করে উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ডিম, মুরগি ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেওয়ার কৌশল বিভিন্ন সময়ে কাজে লাগিয়ে দেদারছে মুনাফা লুটেছে তারা। আবার সুযোগ বুঝে উৎপাদন বাড়িয়ে বেকায়দায় ফেলেছে দেশি খামারিদের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা প্রথম পোল্ট্রি খামার ‘এগ অ্যান্ড হেনস লিঃ’ কিনে নেয় সিপি। কোম্পানিটি বাংলাদেশে প্রথম ব্যবসা শুরু করে গাজীপুর-শ্রীপুরের জয়না বাজারের জনৈক রফিজউদ্দিনের খামার ভাড়া নিয়ে। বছরে মাত্র ৬৬ হাজার টাকায় ৫ বছরের জন্য ওই খামার ভাড়া নেয় তারা। ৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তারা চুক্তি আর নবায়ন করবে না বলে জানিয়ে দেয় রফিজউদ্দিনকে।

এমন কূটকৌশলী মুনাফালোভী কোম্পানি সিপি’র বিরুদ্ধে তাই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ‍দাবি উঠেছে পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্ট সর্ব মহলে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল এর মিডিয়া অ্যাডভাইজর সাজ্জাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সিপি যেভাবে মার্কেট ট্র্যাপ করছে বলে অভিযোগ আছে, তাতে সরকারের মনিটরিং খুবই প্রয়োজন। তারা নিয়ম মেনে বিজনেস করছে কি না সেটা দেখা দরকার।

দেশি খামারিরা তীলে তীলে বাজার গড়ে তুলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, লোকাল কোম্পানি মনে করে, তাদের যেমন মিনিস্ট্রি থেকে পারমিশন নিতে হয়, সেটা সবাইকেই নিতে হোক। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হোক।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।