অভিযোগ উঠেছে, আদালতের নির্দেশেও ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকার কর না দিয়ে সরকারি মহলে অযৌক্তিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে কোম্পানিটি। এমনকি কূটনৈতিক রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেককেও এ কাজে সম্পৃক্ত করেছে।
মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হেড অব মিশন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার যা করেছেন, সেটি কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত, অসৌজন্যমূলক এবং আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল। তাদের দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যদি অন্যায় করা হয়, সেটির প্রতিকার চাওয়ার রেওয়াজ আছে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান অন্যায় ও অন্যায্যভাবে করফাঁকি দিয়েছে তাদের পক্ষে তিনি কিভাবে লবিং করতে গেলেন?’
বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটি ‘ব্রিটিশ- আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)’ নামে পরিচিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ৠালেই ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ৭২.৯১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিএটিবিতে। অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগ ১৪.৫ শতাংশ এবং স্বতন্ত্র বিনিয়োগ ও সরকারি শেয়ার রয়েছে ১.৪৭ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২০১২-১৩ অর্থবছরের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বিএটিবি ব্রিস্টল ও পাইলট ব্র্যান্ডের সিগারেট দু’টিকে কম দামে বাজারজাত করে। এতে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। ওই টাকার মধ্যে বিদেশি মালিকানার ৮৭ শতাংশ বা প্রায় ১ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা বিদেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০০৯ সাল থেকেই ব্রিস্টল ও পাইলট ব্র্যান্ডের সিগারেট কম দামে বাজারজাত করে আসছে বিএটিবি। এ হিসেবে গত ৮ বছরে এ খাত থেকে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকারও (প্রতি বছরে ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ধরে) বেশি পাচার হয়েছে কি-না, সে বিষয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তাপুষ্ট আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি’র অনুসন্ধানেও ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর এসব অনিয়ম উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের প্রথম সারির দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানেও তা প্রকাশিত হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়েবসাইট মানিওয়েব বিবিসি’র প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ২০১৫ সালে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে লবিস্টের মাধ্যমে রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি ও কমোরোস আইল্যান্ডে ২৬ হাজার ডলার ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের কথা উল্লেখ করেছে।
এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কমিশনার মতিউর রহমান বলেন, ‘আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু বিএটিবি উচ্চ আদালতে আপিল করে রেখেছে। তারা নিম্নমানের সিগারেট হিসেবে ব্রিস্টলের অনুমোদন নিয়ে বাজারজাত করে। কিন্তু ল্যাব পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, ডারবি ব্র্যান্ডের উচ্চমানের সিগারেটের সমান মানের ছিল এই ব্রিস্টল’।
‘অনৈতিকভাবে বাজার দখল ও করফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেক বছর ধরেই এ অনিয়ম চলছে বলে ধারণা করা যায়’।
এদিকে উন্নয়নশীল এ দেশে বিদেশি কোম্পানির এ ধরনের অনিয়ম স্থানীয় বিনিয়োগকারীদেরকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিটির সামান্য বিনিয়োগের বিপরীতে বিপুল অংকের লাভও এ ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘লাভের বিশাল অংশই বিভিন্ন কৌশলে নিয়ে যায় তারা। বিদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি খাতে দাম বাড়িয়ে মুনাফা কম দেখায়। এইভাবে তারা করফাঁকি দেয়। অতীতে এ ধরনের অনেক ঘটনা বিভিন্ন দেশে ঘটেছে। বাংলাদেশেও এখন তারা এ অনৈতিক কাজ শুরু করেছে। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে ট্রান্সফার প্রাইসিং’।
‘তৃতীয় বিশ্বের ওপর এভাবেই তারা দাদাগিরি করে। তামাক উৎপাদনে কৃষকদের বেআইনিভাবে প্রলুব্ধও করে’।
২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর প্রচারিত বিবিসি’র প্যানোরমা অনুষ্ঠানে দেখানো হয়, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো পূর্ব আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের ঘুষ দিয়েছে। দীর্ঘ ৫ মাসের অনুসন্ধান শেষে বিবিসি জানতে পারে, এ ঘুষ কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয় তখনই, যখন কেউ এ সংক্রান্ত শত শত গোপন নথি প্রকাশ করে দেন।
তখন বিবিসি’র কাছে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো’র বক্তব্য ছিল, ‘সত্য কথাটি হলো আমরা বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও দুর্নীতেকে প্রশ্রয় দেবো না, সেটি যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন’।
কেনিয়ায় এ সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে ১৩ বছর কাজ করা পল হপকিন্স বলেন, ‘আমাকে যখন আফ্রিকায় এটিকে ব্যবসার খরচ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তখনই আমি ঘুষ দেওয়া শুরু করি। ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো স্থানীয় লোকজনকে ঘুষ দিচ্ছে এবং আমি সেই সুযোগ করে দিচ্ছি’।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো’র পক্ষে কথা বলায় স্বাস্থ্য সংগঠনগুলোর মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে । তাদের দাবি, এ আচরণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম ভঙ্গ করেছে।
২০১৫ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সেদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার ফিলিপ বার্টনকে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো’র পক্ষে লবিং করার বিষয়ে দোষারোপ করেন। তারা ১৩ মার্চের একটি ছবিও প্রকাশ করেন। যেটিতে দেখা যায়, ফিলিপ বার্টন ইসলামাবাদে এমন একটি সভায় যোগ দেন, যেখানে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তাদের পক্ষে কাজ করতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল।
যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস (এফসিও) এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে তাদের নীতিবিরুদ্ধ বলে মনে করে বলে পাকিস্তানের দ্য নেশন পত্রিকা খবরও প্রকাশ করে ওই বছরের ২০ মার্চ।
সাউথ-ইস্ট এশিয়া টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যালায়েন্সের গত ২৩ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে অবৈধভাবে ২৫ কোটি মালয়েশীয় রিঙ্গিত স্পন্সর করেছিল।
২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কম শুল্কের ইউরোপীয় অঞ্চলে বেশি পরিমাণে তামাক সরবরাহ করায় প্রতিষ্ঠানটিকে সাড়ে ৬ লাখ ইউরো জরিমানাও গুণতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
এএসআর