মূলত বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সীমান্ত এলাকায় বৈধ বাণিজ্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে এসব সীমান্ত হাটের যাত্রা। পাশাপাশি চোরাকারবারীদের ঠেকাতে ও সীমান্তে বসবাসকারীদের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে দুই দেশের সরকার এ হাট চালু করে।
২০১০ সালের মে মাস থেকে এ হাটে আনুষ্ঠানিক বেচা-কেনা শুরু হয়। তবে যে কেউ চাইলে এ হাটে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না। দুই দেশের সীমান্ত থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত যারা বসবাস করে তাদেরই মূলত সীমান্ত হাটের কার্ড দেওয়া হয়। এ কার্ড ব্যবহার করে এক ব্যাক্তি ২শ ডলার তথা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৭ হাজার টাকার পণ্য কিনতে পারেন প্রতি বাজারে।
এ হাটের জন্য বাংলাদেশ অংশে ৫৯৭ জনকে জনকে ক্রেতা কার্ড দেওয়া হয়েছে। ঠিক একইভাবে ভারতের ৫শ জন ক্রেতাকে কার্ড দেওয়ার কথা থাকলেও ওই অঞ্চলে লোকজন কম হওয়ার ফলে ৩শ জন এ কার্ড নিয়েছেন। বাকি ২শ এখনও খালি রয়েছে। কার্ডধারীরা এ বাজারে কেনা-কাটা করতে আসেন প্রতি হাটের দিন। দুই দেশ মিলে মোট ৫০ জন ব্যবসায়ী দোকান সাজিয়ে বসেন এ হাটে। এ ছাড়াও বিএসএফ সদস্যরা বিভিন্ন সীমান্ত থেকে এসে নিজেদের জন্য সবজিসহ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে থাকেন। ঈদ উপলক্ষে মসলার চাহিদা বেশি ভারতীয় বাজারে। বাংলাদেশি ক্রেতারা এ সময়টাতে বেশি বেশি মসলা জাতীয় পণ্য ক্রয় করেন। ঈদের জন্য বাজারে বিশেষ ভাবে কোনো প্রকার পণ্য আসে না। এ ছাড়াও আর বাকি সব পণ্য স্বাভাবিকভাবে ক্রয় বিক্রয় চলছে।
বাংলাদেশিদের কাছে ভারতীয় যে পণ্য গুলো জনপ্রিয় সেগুলো হলো- পান, সুপারি, কসমেটিকস, জুতা, জিরা, আদা, কিসমিসসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। এ হাটে দুই দেশের ৫২টি পণ্য বিক্রির অনুমতি রয়েছে। সেই অনুযায়ী চলে পণ্য বিক্রি। ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের যে পণ্যগুলো জনপ্রিয় সবজি, প্লাস্টিকের সব ধরনের সামগ্রী, কাপড়, গৃহস্থলী তৈজসপত্র, মেলামাইনের জিনিস, লিচু ড্রিং, চানাচুরসহ কম দামে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যায় ভারতীয়রা।
এদের মধ্যে খাসিয়া মাইনাজা, গারো ও হিন্দু সম্প্রদায় রয়েছে। মাইনজারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। তবে সামান্য ইংরেজি ও হিন্দি সংমিশ্রণে কথা বলে বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করে। বাজারের মাঝখানে একটি ঘর রয়েছে, সেই ঘরের দুই পাশে বসে বাজার।
বাংলাদেশের সীমান্তের পাশে বাংলাদেশি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা আর ভারতের সীমান্তে পণ্য নিয়ে বসেন ভারতীয়রা। এ ভাবে বাজার দুই ভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশ অংশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আর ভারতের অংশের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ। এ বাজারে বাংলাদেশ অংশে প্রতি হাটে প্রায় ১০ লাখ টাকার কেনা বেচা হয়। আর ভারতের অংশে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার পণ্য বেচা কেনা।
বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে এই বর্ডার হাটটি। এখানে শুল্ক ছাড়াই পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেত পেরে খুবই সন্তুষ্ট দুই পারের মানুষজন।
বাংলাদেশ অংশে কম বিক্রি হওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশ অংশে বেলা ১১টায় হাট খুলে দেওয়া হলেও ভারত থেকে গেট খোলা হয় দুপুর ১টায়। সেকারণে ভারতীয় ক্রেতারা কম আসে, বেচা-বিক্রিও কম হয়। আবার বিকেল ৪টার সময় হাট বন্ধ হয়ে যায়। তাই ভারতীয়দের তুলনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিক্রি কম।
স্থানীয় ও ব্যবসায়দের দাবি, আরও বেশি করে যেন ব্যবসায়ী ও ক্রেতা কার্ড দেওয়া হয়। তা হলে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
এ বাজারের প্রধান সমস্যা গুলোর মধ্যে বিশুদ্ধ পানির কোনও ব্যবস্থা না থাক অন্যতম। এছাড়া বাথরুমগুলোও নষ্ট হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বাজারের নিরাপত্তার জন্য যে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে সে গুলোও বিগত ১০ বছরে নড়বড়ে হয়ে গেছে। এর জন্য জরুরি ভিত্তিতে এগুলো সংস্কার এবং খাবার পানির জন্য একটি টিউবওয়েল স্থাপন প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
ভারত থেকে আসা ক্রেতা শেলি দে বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাংলাদেশি পণ্য কিনতে পেরে অনেক খুশি। আপনাদের দেশে দামও অনেক কম। পণ্যগুলো মানসম্পন্ন। আমি ভারতের শিলং থেকে কাপড় কিনতে এসেছি মেয়ের জন্য। মাসে এক-দুই বার আসি।
আরেক ক্রেতা এস আর মারকা বাংলানিউজকে বলেন, আমি প্লাস্টিকের জিনিস কিনতে এসেছি, এখানে ভালো জিনিস পাওয়া যায়। দামও আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম। ভালো লাগে তাই আসি।
বাংলাদেশের ক্রেতা দ্বীন ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমি ছোটো-খাটো ব্যবসা করি। এখান থেকে কিছু পণ্য কিনেছি আমাদের ডলুরা স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য। এখানে হাট হওয়ার ফলে আমাদেরও একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
করিম মিয়া আরেক ক্রেতা বলেন, সামনে ঈদ তাই আমি কিছু মসলা কিনতে এসেছি। জিরা, গরম মসলা এখানে কম দামে পাওয়া যায়। এই হাট হওয়ার ফলে আমারদের গ্রামে চোরের সংখ্য কমে গেছে। যদি এখানে শুল্ক স্টেশেন হয় তালে আরও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। আর এলাকার বেকারত্ব কমে যাবে।
বাজার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোকশেদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, এখানে হাট হওয়ার ফলে এলাকার লোকজনের অনেক উপকার হয়েছে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। ভারতের তুলনায় আমার এলাকায় লোক সমাগম বেশি। তাই ক্রেতা কার্ড আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বাজারে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধানে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
২৮ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোকসুদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এখানে চোরাকারবারী বন্ধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করি। এছাড়া আমাদের আর তেমন কোনও দায়িত্ব নেই। সব কিছু স্থানীয় প্রশাসন দেখে।
বর্ডার হাট কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বাংলানিউজকে বলেন, এ বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাদের কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আমরা নতুন করে মেয়াদ ঠিক করে দেবো। এ ছাড়া যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো খোঁজ খবর নিয়ে সমাধান করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ৯০৪২ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৯
এসএইচ