ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বন্ড দুর্নীতি: আটকে আছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৭ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৯
বন্ড দুর্নীতি: আটকে আছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব

ঢাকা: বন্ড দুর্নীতির পাঁচ শতাধিক মামলায় আটকে রয়েছে ৩ হাজার ৬৪২ কোটি টাকার রাজস্ব। এখনই বন্ড চুরি বন্ধ করতে না পারলে বছরে রাজস্ব ক্ষতি হবে একলাখ কোটি টাকা। 

এ পর্যন্ত বন্ড চুরির ৫১৪টি মামলায় কোনো গ্রেফতার নেই। রাজস্ব খাতে চুরি ছাড়াও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা কাপড়, কাগজসহ বিভিন্ন উপকরণ খোলা বাজারে খোলামেলাভাবেই বিক্রি হচ্ছে।

এতে বিপন্ন হচ্ছে দেশি কাগজ, কাপড়, প্লাস্টিক শিল্প। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাণিজ্যিক আমদানিকারকেরা।  

সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইনের আওতায় রপ্তানিমুখী খাতকে বন্ডেড ওয়্যারহাইজ বা বন্ড সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে কোনো শুল্ক ছাড়াই কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পেয়েছে দেশের রপ্তানি খাত। শর্ত একটাই এ কাঁচামালে তৈরি পণ্য পুরোটাই রপ্তানি করতে হবে। এ সুবিধার সবচেয়ে বড় উপকারভোগী তৈরি পোশাক খাত। রপ্তানির বিকাশে এ সুবিধা চালু করতে গিয়ে সরকারকে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ছাড় দিতে হচ্ছে। এ সুবিধার অপব্যবহার করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বছরে যে পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে তার পরিমাণ হবে ৫২ হাজার কোটি টাকা যা আগামী বছগুলোতে একলাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।  

>>>আরও পড়ুন...বন্ডেড পণ্য কালোবাজারে, অসাধু চক্রকে রুখবে কে?

ব্যবসায়ীরা গত কয়েক বছর ধরেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কাছে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার বন্ধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছেন। প্রতিবছর বাজেটের আগে তাদের এ দাবি আরও জোরালো হয়। এনবিআর থেকেও কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কার্যত কিছু অভিযান, পণ্যবোঝাই ট্রাক জব্দ, বন্ড লাইসেন্স স্থগিত ও মামলা দায়েরের মধ্যেই সীমিত থাকছে তাদের কার্যক্রম। একদিকে লাইসেন্স বাতিল হয় অন্যদিকে নতুন লাইসেন্সও দেওয়া হচ্ছে। মামলা হলেও কেউ গ্রেফতার হয় না। মামলা নিষ্পত্তি হয় না সহজে, পাওনা শুল্কও আদায় হয় না। ফলে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার থামছে না।

সবচেয়ে বড় উপকারভোগী পোশাক খাত। তবে অপব্যবহারের দায় নিচ্ছে না তৈরি পোশাক এবং এ শিল্পের সহযোগী প্যাকেজিং ও অ্যাক্সেসরিজ শিল্প। জনবল সঙ্কটের দোহাই দিচ্ছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। এনবিআর’র এ প্রতিষ্ঠানটি বন্ড লাইসেন্স দেয়। বন্ড সুবিধায় আনা কাঁচামাল রপ্তানিমুখী শিল্পে ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদেরই।  

পোশাক খাতে কাপড়সহ কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করতে হবে তার প্রকৃত হিসাব নেই বন্ড কমিশনারেটের কাছে। কী পরিমাণ কাঁচামাল লাগবে তা নির্ধারণ করে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) দেবে তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ। অ্যাক্সেসরিজের কাঁচামালের পরিমাণ নিরূপণ করে ইউটিলাইজেশন পারমিশন (ইউপি) দেয় প্লাস্টিকখাতের সংগঠন বিপিজিএমইএ। এদের দেওয়া তথ্য যাচাইয়ের সক্ষমতা নেই বন্ড কমিশনারেটের। ফলে রপ্তানির নামে কী পরিমাণ কাপড়, কাগজ বা প্লাস্টিক কাঁচামাল আসছে, সেগুলো কারখানায় আদৌ ব্যবহার হচ্ছে কি না, খোলা বাজারে কী পরিমাণ যাচ্ছে তার সঠিক তথ্য নেই কারো কাছে। ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলে বন্ডের মালামাল আমদানির লেনদেন করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায়ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়নি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার অভাবে বন্ডে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অভিযানে পণ্যের কিছু চালান ধরা পড়লেও বন্ড দুর্নীতির হোতারা আড়ালে থাকছে।  

বাস্তবে অস্তিত্বহীন কিন্তু কাগজে কলমে কারখানার নাম দেখিয়ে বিনা শুল্কে বন্ডে পণ্য আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এক সময় উৎপাদনে ছিল এখন নেই এমন কারখানার নাম ব্যবহার করেও বন্ড দুর্নীতি হয়েছে। তদন্তকালে এসব কারখানার মালিকের নাম পরিচয় খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে এনবিআর। অল্প কয়েকজনকে চিহ্নিত করা সম্ভব হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাল কাগজপত্র ব্যবহারের করে বছরের পর বছর এসব দুর্নীতি করেছে।  

অভিযানে অনিয়ম ধরা পড়লে বন্ড লাইসেন্স বাতিল হয়। আবার নতুন নামে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। গত জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ২২৮টি অস্তিত্বহীন ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার। আবার গত তিন মাসে ৪২টি নতুন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্ড দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছে বড় কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম, যাদের রপ্তানিখাত ছাড়া অন্য ব্যবসা রয়েছে। তারা নিজের বিশ্বস্ত লোককে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক সাজিয়ে এ অপকর্ম করছে।  

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন কৌশলে বন্ড দুর্নীতি হচ্ছে। এরা শক্তিশালী চক্র। সারাদেশে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার ৮০৯টি। এসব প্রতিষ্ঠান দেখাশুনার জন্য মাত্র দুইজন বন্ড কমিশনার রয়েছে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, মাত্র দুই বন্ড কমিশনার আওতায় ৩শ’র মতো কর্মরত রয়েছে। এ অল্প লোকবল দিয়ে সারাদেশের বন্ড দুর্নীতি নজরদারি করা সম্ভব নয়। ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রামে আরেকটা বন্ড কমিশনারেট রয়েছে।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার হুমায়ুন কবীর বাংলানিউজকে বলেন, আমদের লোকবলের স্বল্পতা অল্প সময়ে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আমি এ দপ্তরে যোগদানের পর বন্ড কার্যক্রম নজরদারিতে আরও জোর দিয়েছি। অভিযান চলমান রয়েছে।  

ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বন্ড অটোমেশনের উদ্যোগ নিয়েছিল এনবিআর। গত মার্চ মাসে এনবিআর থেকে বলা হয়েছিল, এ বিষয়ে তাদের গবেষণার কাজ শেষ। অন্যান্য দেশে বন্ড ব্যবস্থাপনা মূল্যায়ন করে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি আইটি ফার্মকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর অগ্রগতির কথা জানা যায়নি। চলতি বাজেটে আয়কর আদায়ের জন্য কর অঞ্চল দ্বিগুণ করা, প্রতি উপজেলায় কর অফিস স্থাপন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ১০ হাজার তরুণকে নিয়োগসহ নানা আয়োজনের কথা থাকলেও বন্ড কমিশনারেটের জনবল বাড়ানোর কোনো কথা নেই।

অনেকদিন ধরে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনায় উদ্যোগ নিলেও তা এখনো সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। মিথ্যা তথ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধে স্ক্যানিং যন্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ কেবল প্রস্তাবিত বাজেটে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। কবে এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হবে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই।  

ব্যবসায়ী নেতা এফবিসিআই’র সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বন্ড দুর্নীতি অসাধু ব্যবসায়ীর একার পক্ষে করা সম্ভব না। অনেক সুবিধা নিয়ে এ দুর্নীতি করতে ব্যাংক ও এনবিআরের কোনো না কোনো অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সহযোগিতা করছে। তাই বন্ড দুর্নীতি বন্ধে অসাধু ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারির পাশাপাশি ব্যাংক ও এনবিআরের অসাধু কর্মকর্তাদেরও ওপরও সমান নজরদারি করতে হবে।

শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, কেউ মিথ্যা তথ্যে বন্ড সুবিধা নিতে না পারে এজন্য আমরা ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে নজরদারি বাড়িয়েছি। এছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ড দুর্নীতি করছে এমন তথ্য পাওয়া গেলে তাকে আমরা বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি সালাম মুর্শেদি বাংলানিউজকে বলেন, প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বন্ড দুর্নীতি করে না। দেশের শত্রুরা এ দুর্নীতিতে জড়িত। এদের দৃষ্টাতমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। এ কাজে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

এনবিআর’র চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, দুর্নীতিবাজরা বিভিন্ন কৌশলে বন্ডের অপব্যবহার করছে। এ কাজে কোনো অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সহযোগিতা করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে অসাধু ব্যবসায়ীদের পাশপাশি তাদেরও দৃষ্টামূলক শাস্তি দেওয়া হবে।

বন্ড অপব্যবহারকারীদের কাছে দৃশ্যত অসহায় বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এনবিআর থেকে বন্ড দুর্নীতি বন্ধে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। এসব অভিযানে অধিকাংশ সময়ে পণ্য ও পণ্য বহনকারী পরিবহন আটকেই সীমাবদ্ধ থাকে। মূল অপরাধীকে সম্ভব হয়না। বন্ড দুর্নীতিবাজ গডফাদাররা এত শক্তিশালী যে অনেক সময় তাদের দলের লোকদের ধরতে গেলে অভিযানে এনবিআর কর্মকর্তাদের মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।

অভিযানে বন্ড দুর্নীতিতে জড়িত প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার পর প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়ে চূড়ান্ত তদন্তে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে মামলা পর্যন্ত সময় লেগে যায় ছয় মাস বা তারও বেশি। এরপর অধিকাংশ মামলা বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে আপিল বিভাগ পর্যন্ত পৌঁছাতে পার হয়ে কয়েক বছর। এরমধ্যে বন্ড দুর্নীতিবাজরা নিজেদের দলের নতুন ব্যক্তিদের নামে নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে আবারো বন্ড দুর্নীতি চালাতে থাকে।

এনবিআর সূত্র জানায়, বন্ড দুর্নীতিতে চূড়ান্ত শাস্তি হিসেবে লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল এবং জরিমানা ও পাওনা রাজস্ব আদায় করা হয়। তবে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত হলেই সাময়িকভাবে বিন লক (ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর) করা হয়। এতে ওই প্রতিষ্ঠান আর আমদানি-রপ্তানি করতে পারে না। বন্ড মামলা করার চেয়ে বিন লক, পাওনা আদায় ও জরিমানা বেশি করা হয়।  

এ পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ৫১৪টি। এসব মামলায় জড়িত রাজস্ব ৩ হাজার ৬৪২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বন্ড দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় দায়ে এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ফৌজদারি মামলা হলে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু বন্ড দুর্নীতিতে কাস্টমস আইনে মামলা করা হয়। ফৌজদারি নয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০০৯ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৯
এসই/টিআর/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।