দেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় বড় খাত চামড়াশিল্প। এ শিল্পের ৮০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান আসে কোরবানির ঈদে।
বুধবার (১৪ আগস্ট) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি ও কখনও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতে নগরবাসীর মনে শান্তি এলেও মাথায় হাত পড়েছে দেশের চামড়া ব্যবসায়ীদের। ঈদের তৃতীয় দিন বুধবার পোস্তায় তেমন কোনো কাঁচা চামড়া না আসায় ব্যস্ততা না থাকলেও হতাশা ছিল ব্যবসায়ীদের চোখে-মুখে।
এদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চামড়া আসেনি। ফলে নেই কাঁচা চামড়া বেচাকেনা, বিক্রেতা, আড়তদার ও কর্মচারীদের কর্মচাঞ্চল্য। কয়েকজন মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া নিয়ে এলে শত চেষ্টা করেও বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে কোরবানির ঈদের পর অন্য বছর যে কর্মব্যস্ততা দেখা যায় এবছর সে রকম কোনো চিত্র দেখা যায়নি।
ঢাকার আশপাশ থেকে দু’একটি চামড়া এলেও তা দাম না থাকায় ফেলে চলে যাচ্ছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। দাম ও ক্রেতা না থাকায় রাস্তার পাশেই স্তূপ আকারে পড়ে আছে চামড়া। রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে গরু, ছাগলের চামড়া। ফলে পোস্তার রাস্তা, অলি-গলিতে পড়ে থাকা চামড়া পচে কটূ গন্ধে দম নেওয়া দায়। তবে সকাল থেকেই সিটি করপোরেশনের সুইপাররা পচা চামড়া সরাতে ব্যস্ত ছিল।
সুইপার হরিস বর্মন বাংলানিউজকে বলেন, ছোট থেকে এ কাজ করে আসছি। প্রতি বছরই আমরা ঈদের পর এখান থেকে বর্জ্য পরিষ্কার করি। কিন্তু এবছর বর্জ্যের পাশাপাশি আস্ত পচা চামড়াও সরাতে হচ্ছে। যা কোনো দিন আমরা দেখিনি বা করিনি। আজ তো কম, গতকাল রাতে আরও অনেক সরানো হয়েছে।
পোস্তার ব্যবসায়ীরা জানান, এখনও কোনো কোনো আড়তে কাচা চামড়া সংরক্ষণে লবণ দেওয়ার কাজ চলছে। আড়তে চামড়া লবণজাত অবস্থায় থাকবে ২০ থেকে ২৫ দিন। এরপর এখান থেকে চামড়া নেবেন ট্যানারি মালিকরা। পুঁজি না থাকায় পোস্তা এলাকার অধিকাংশ আড়তদার চামড়া কেনা বাদ দিয়ে অবসর সময় পার করছেন। তবে দরপতনের এ পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি ও আড়তদাররা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। একই সঙ্গে রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনাসহ সিন্ডিকেটের অভিযোগ। এতে বিপাকে পড়ছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তারা বলেন, চামড়া দেশের সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। গুণগতমানের দিক থেকেও বাংলাদেশের গবাদি পশুর চামড়া উন্নতমানের। আর সে কারণে এক সময় বিদেশি বায়াররা এদেশ থেকে চামড়া কিনতো। অথচ এখন তারা বাংলাদেশবিমুখ। এর কারণ সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। চামড়াশিল্পকে টিকিয়ে রাখা শুধু নয় বিকশিত করতে হলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে পাটশিল্প যেমন ধ্বংস হয়ে গেছে, চামড়াশিল্পও ধ্বংস হয়ে যাবে।
হতাশাগ্রস্ত কণ্ঠে হাজি জয়নাল বাংলানিউজকে বলেন, এতোদিন ধরে ব্যবসার সঙ্গে আছি কিন্তু এত বাজে ব্যবসা আর কখনও দেখিনি। ঈদের পর যে পোস্তায় কাচা চামড়া কেনা-বেচা, প্রক্রিয়াজতকরণে শ্রমিকরা থাকতো ব্যস্ত, এবার তারা অতীতের দিনগুলোর মনে করে দিন কাটাতে হচ্ছে। আসলে ভালো চামড়ার দাম কমেনি। কমেছে নষ্ট চামড়ার দাম। অনেক ব্যবসায়ী নষ্ট চামড়া কম দামে কিনে এখন মাথা হাতাচ্ছে।
শ্রমিক আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, গত ১০ বছর ধরে এখানে কাজ করে। এবছরের মতো অবস্থা কোনোদিনও দেখিনি। আজ রাস্তায় যে চামড়া পড়ে থাকতে দেখছেন, দাম থাকলে রাস্তায় রাস্তায় থাকতো না। ছেঁড়া-ফাটা সবই তখন বিক্রি হয়ে যেত।
এর আগে মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া বেচাকেনা নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ করে সরকারের নেওয়া এ সিদ্ধান্তে এ শিল্প খাতের কোনো উপকার হবে না বলে মনে করেন আড়তদাররা।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, চামড়ার বাজারে কোনো সিন্ডিকেট হয় না। প্রতিবছর ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেটের কথা বলেন, কিন্তু এটি সঠিক নয়। সমস্যা হয় তাদের কাছে পাওনা টাকা যখন আমরা পাই না তখনই। তারা প্রচুর টাকা বকেয়া রেখেছেন। তাদের কাছে ৩৫০ কোটি টাকার মতো পাওনা রয়েছেন আমাদের আড়তদাররা। কিন্তু আমরা একেবারেই চামড়া কিনছি না বিষয়টি তেমন নয়, কিন্তু আমরা যে পরিমাণ কিনতে চাচ্ছি তা পুঁজির অভাবে কিন্তু পারছি না। সবার কাছে টাকা থাকলে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকতো, ফলে চামড়ার দামও বাড়তো।
তিনি বলেন, আমরা প্রথম দিন চামড়া কিনেছি। কারণ সে দিনের চামড়াটা ভালো ছিল। এখন যে চামড়াটা আসছে সেটা ৬ ঘণ্টা পর নষ্ট হয়ে যায়৷ আমরাতো জেনেশুনে লোকসান দিতে পারবো না। ফলে নষ্ট চামড়াগুলো ফেলে দিতে হয়েছে। এজন্য আমরা বারবার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলেছি চামড়া কেনার ছয় ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিয়ে রাখতে। যদি তারা এটা করতো তাহলে এতো চামড়া নষ্ট হতো না। অনেকে বলেছে দাম পরে দিয়েন চামড়া রেখে দেন। কিন্তু আমরা জেনে শুনে নষ্ট চামড়া রাখতে পারি না।
আড়তদার হাজি ছমিরউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, কোরবানির কমপক্ষে ৩৬ ঘণ্টা পর সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্তের কথা জানালো। অথচ ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার সেটা হয়েই গেছে। কমপক্ষে ৪/৫ মাস আগে থেকে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রচারণা চালালে ব্যবসায়ীরা লোকসানের হাত থেকে বেঁচে যেত।
এদিকে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ( বিটিএ)। সকালে সংবাদ সম্মেলনে বিটিএ'র সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ বলেন, আমরা ২০ আগস্ট থেকে চামড়া সংগ্রহ শুরু করবো। সেই সময় চামড়ার বাজার স্থিতিশীল থাকবে। আশা করছি এ সময়ের মধ্যে সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দিলে শতভাগ দেশীয় এ শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। চামড়া শিল্পনগরীতে সাত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্পনগরী প্রয়োজনীয় কাঁচা চামড়ার অভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়বে। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে পড়বে, ফলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেবে।
সিন্ডিকেট করে একটি চক্র চামড়ার দাম কমিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে চামড়ার এই অবস্থার জন্য ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন জড়িত কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে সংগঠনের সভাপতি বলেন, আমরা কখনও কাঁচা চামড়া কিনি না। পাঁচ থেকে ছয়জনের হাতবদল হয়ে তারপর আমাদের কাছে চামড়া আসে। সুতরাং কাঁচা চামড়ার এই দরপতনের সঙ্গে কোনোভাবেই বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন জড়িত নয়।
সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া দাম অনুযায়ী ঢাকায় কোরবানির গরুর প্রতিটি ২০ থেকে ৩৫ বর্গফুটের চামড়া লবণ দেওয়ার পরে ৯০০ থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকায় কেনার কথা ট্যানারি মালিকদের। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় চামড়া কিনেছেন। আর রাজধানীর বাইরে দেশের অন্য স্থানে চামড়া বেচা-কেনা হচ্ছে আরও কম দামে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৯
জিসিজি/এএ