গত সাত বছরের চামড়ার দাম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যে হারে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কমেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কমানো হয়েছে স্থানীয় বাজারে। এমন বাস্তবতায় আমাদের দেশে চামড়াজাত পণ্যের দাম কমা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ঠরা।
সংশ্লিষ্ঠরা জানান, জুতা, ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, জ্যাকেট, মোবাইল কভার এবং নামীদামি ফার্নিচারের আবরণ তৈরির অন্যতম উপকরণ হচ্ছে চামড়া। সেসব পণ্য দেশে-বিদেশে আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ ধারাবাহিকভাবে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে এসব পণ্য তৈরির অন্যতম উপকরণ চামড়ার দাম। আমাদের দেশের নামীদামি ব্র্যান্ডগুলোতে যেকোনো চামড়াজাত পণ্যের দাম শুরু হয় হাজার টাকা থেকে। একটি ভালো চামড়ার বেল্ট কিনতে ক্রেতাকে খরচ করতে হয় ১৫শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। অথচ এ বছর দেশে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে কেনা সবচেয়ে বড় গরুর চামড়াও বিক্রি হয়েছে ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকায়। অথচ গত সাত বছরে প্রতি বর্গফুটে চামড়ার দাম ৪০ টাকা কমলেও অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে চামড়াজাত পণ্যের দাম।
এ বিষয়ে সিনিয়র বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে চামড়ার দাম কম। তবে চামড়াজাত পণ্যের দাম তিনগুণ বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে কম দামে পৃথিবীর কোথাও চামড়া পাওয়া যায় কি-না, আমি জানি না।
তিনি বলেন, সরকার চামড়া রফতানি এবং এখাতে দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা দিচ্ছে। দ্রুত স্থানান্তরের ফলে বর্জ্য শোধনাগার এখনও সম্পন্ন করতে পারিনি। তবে প্রয়োজনে সরকার আরও একটি বর্জ্য শোধনাগার প্লান্ট (সিইপিটি) নির্মাণ করবে।
বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, চামড়া নিয়ে সবাই বিপাকে পড়ে আছে। আমাদের দেশের সিইটিপি এবং কমপ্লায়েন্সের দূরাবস্থার কারণে বাইরের ক্রেতারা আগ্রহী হচ্ছেন না। কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু চামড়ার দাম কম তাই দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর চামড়াজাত পণ্যের দামও কমা উচিত। কেননা তারা কম দামে এদেশ থেকে চামড়া কিনছে এবং এদেশেই বিক্রি করছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, চামড়ার দাম অনুযায়ী চামড়াজাত পণ্যের দাম দেশের বাজারে বেশি হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক কম। কাঁচা চামড়া দিয়ে কোনো পণ্য তৈরি করা যায় না। যার কারণে চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশি। এক জোড়া ব্র্যান্ডেড জুতো তৈরি করতে ১শ’ ডলার খরচ হলে সেখানে চামড়ায় খরচ হয় দুই থেকে তিন ডলার। এরসঙ্গে চামড়াটাকে কেমিক্যাল দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হয় এবং ব্র্যান্ডিং, বিজ্ঞাপনসহ আনুষাঙ্গিক নানা খরচ মিলিয়ে ১৫০ থেকে ২শ’ ডলারে বিক্রি করতে হয়। কারণ ব্র্যান্ডেড প্রতিষ্ঠানগুলো ২শ’ শতাংশ লাভ করে থাকে। এছাড়াও আমাদের দেশে সেই জুতা সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। একই জুতা ইউরোপের বাজারে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। সে হিসাব করলে আমাদের দেশের চামড়াজাত পণ্যের দাম কম।
এদিকে ক্রেতাদের মধ্যে আছে চামড়াজাত পণ্যের দাম নিয়ে অসন্তোষ।
ক্রেতা ইমন সারোওয়ার বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি বছরই কাঁচা চামড়ার দাম কমে। কিন্তু চামড়াজাত পণ্যের দাম কমে না কেন? তারপর আমাদের দেশের চামড়াজাত পণ্যের মান অনুযায়ী দাম অনেক বেশি। তাই ইচ্ছে থাকলেও চামড়ার পণ্য অনেক সময় কিনতে পারি না। সরকারে সুষ্ঠু মনিটরিং ব্যবস্থা ও নজরদারি বাড়ালে এ খাত থেকে আমরা সবাই লাভবান হতে পারি। কিন্তু সরকার সেটা করছে না। ফলে গুটি কয়েক লোকের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও সাধারণ মানুষ।
ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, একটি চামড়া যদি প্রতি বর্গফুটে ৫০ টাকা এবং ফিনিশড করা জন্য আরও ৫০ টাকা যোগ করা হয় তাহলে একটি মোটামুটি ভালো মানের জুতোর দাম ১৫শ’ টাকা পড়ে। কিন্তু এই জুতোই আমাদের দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডগুলোতে বিক্রি করা হচ্ছে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকায়।
দেশে পাওয়া বিভিন্ন আকারের গরু থেকে সাধারণত সর্বনিম্ন ১৮ বর্গফুট এবং সর্বোচ্চ ২৬ বর্গফুট চামড়া মেলে। আবার এক জোড়া উন্নতমানের জুতা তৈরি করতে সর্বোচ্চ তিন বর্গফুট চামড়ার প্রয়োজন হয়। এ হিসেবে একটি গরুর চামড়া দিয়ে কমপক্ষে সাত জোড়া জুতা তৈরি হয়। শুধু একটি কোমরের বেল্টের দামই আস্ত একটা গরুর চামড়ার দামের চেয়ে বেশি। এক জোড়া জুতার দাম গড়ে তিন হাজার টাকা দাম ধরলেও একটি গরুর চামড়ায় ব্যবসা হয় কমপক্ষে ২১ হাজার টাকা। দুই বছর আগে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যে জুতা এক হাজার ৮শ’ থেকে দুই হাজার ৪শ’ টাকায় বিক্রি হতো সেগুলোর দাম এখন সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর জুতার দাম আরও বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম বিশ্লেষক ইনডেক্সমুডির তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম ছিল প্রতি পাউন্ড প্রায় এক ডলার। আর সে বছর দেশে কোরবানির সময় গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি বর্গফুট ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। এরপর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম বেড়ে হয় এক ডলার ১৪ সেন্ট। কিন্তু যে বছর দেশে চামড়ার দাম কমানো হয়েছে, সেসময় আগের বছরের চেয়ে ১০ টাকা কমিয়ে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭৫ থেকে ৭০ টাকা। এরপর অবশ্য বিশ্ববাজারেই দাম কমতে থাকে। বর্তমানে প্রতি পাউন্ড চামড়া ৭০ সেন্টের কাছাকাছি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। সে হিসাবে গত সাত বছরে বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। আর দেশের বাজারে কমানো হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ সময়: ০২০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৯
জিসিজি/ইউবি/এসআরএস