ঢাকা: স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের ফলে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শুল্ক সুবিধা ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা ক্রমান্বয়ে চলে যাবে। রপ্তানি আয়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ পতন হতে পারে বলে দাবি করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
এলডিসির তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ প্রসঙ্গে রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) এক ভার্চ্যুয়াল আলাপচারিতায় এ কথা বলেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, রফতানি আয়ে পতন হবে মূলত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও কানাডিয়ান বাজারে। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ান বাজারে আমি পরে আসছি। সব স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাজার যাবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যাবে প্রায় ৮৫ শতাংশ। এটা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) হিসাব থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে আপনাদের মনে রাখতে হবে ২০২৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার সুবিধা চলে গেলেও আরো তিন বছর এটা অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাজ্যও বলেছে, তারা একইভাবে এটা অব্যাহত রাখবে। আমি একটা বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যতোখানি না রপ্তানি নিয়ে আলোচনা হয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও চাপগুলো সৃষ্টি হবে। অনেক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও এই আলোচনা কেউ করে না। তার অন্যতম কারণ হলো, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলোচনার সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো মিল নেই।
বৈদেশিক ঋণে সুদ বাড়বে জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা, এডিবি—যত আমরা এগোব তত বেশি উচ্চ মূল্যের ঋণ আমাদের নিতে হবে। এমনকি কিছু কিছু দ্বিপাক্ষিক দাতা গোষ্ঠীও এখানে চলে গেছে। জাপানও একইভাবে ব্লেনডেড ফাইন্যান্সে চলে গেছে। তাদের কাছ থেকে বাড়তি সুদে ঋণ নিতে হবে। আরও একটা আলোচনা খুব বেশি হয় না, সেটা হলো—কৃষিতে এখন ভর্তুকি আরও কমবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত দেশ থেকে বের হচ্ছে গত ৪৮ ঘণ্টায় এই নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। প্রথমে স্মরণ করে দিতে চাই। স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিটা তৈরি হয় ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘে। তখন ৭৫টা দেশ ছিল। এখন প্রায় ৪৬টি দেশ আছে। যেখানে পৃথিবীর ১৩ শতাংশ মানুষের বসবাস। অথচ ১৩ শতাংশ জনসংখ্যার কাছে বৈশ্বিক জিডিপি মাত্র ১ শতাংশ। এদের বৈশ্বিক বাণিজ্যের হারও মাত্র ১ শতাংশের নিচে। দারিদ্র্য যদি হিসাব করেন দেখবেন প্রায় ৪০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ স্বল্পোন্নত দেশে বসবাস করেন। এখানে ইন্টারনেটের অভিগম্যতা মাত্র ২০ শতাংশ। পৃথিবীর ১৩ শতাংশ মানুষ সামান্য সম্পদের মালিক। সে জন্য ক্যাটাগরিতে এই মুহূর্তে ৪৬টি দেশ আসছে। এঙ্গোলা এলডিসি থেকে বের হতে চায় না। যেহেতু তেলের দাম কমে গেছে। কারণ কোভিডে উন্নয়নের গতি কমে গেছে তাই এঙ্গোলা এলডিসি থেকে বের হতে চায় না। দেশটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই বিষয়ে অনুরোধ করেছে। ভুটান ২০২৩ সালে এলডিসি থেকে বের হবে। দ্বীপরাষ্ট্র সলোমন আইল্যান্ড ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হতে চাচ্ছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সদ্য সমাপ্ত যে মিটিং হলো সেখানে আমরা পাঁচটি দেশ নিয়ে আলোচনা করেছি বাংলাদেশ, নেপাল, লাওস, মিয়ানমার ও তিমুর লেসতে। এর ভেতরে বাংলাদেশের ব্যাপারে আপনাদের সবার আগ্রহ বেশি। তিনটি সূচকে বাংলাদেশ সফলকাম হয়েছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিনটি সূচকে ভালো করেছে বাংলাদেশ। আপনাদের স্বরণ রাখতে হবে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ এই তালিকায় যুক্ত হয়, যদিও ১৯৭৩ সাল থেকে এর দর কষাকষি শুরু হয়। কারণ বাংলাদেশকে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকের অনীহা ছিল। সেই সময়ে স্বল্পোন্নত দেশের যে সংজ্ঞা ছিল তাতে ১ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ কেউ আসবে না। পরবর্তীতে এটা দুই কোটি করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সাড়ে ৭ কোটি মানুষ নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল।
তিনি বলেন, ফলে এতো বড় জনসংখ্যার দেশকে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেরই আপত্তি ছিল। প্রফেসর নুরুল ইসলাম (বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম) খুব জোরদারভাবেই আমাদের পক্ষ হয়ে বলেন। তার পরেই এলডিসিতে বাংলাদেশকে যুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমাদের প্রতি যে সহমর্তিতা ছিল এটাকে যুক্ত করাই তার বহিঃপ্রকাশ। নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশ এই তালিকায় থাকার ফলে বিগত ৫০ বছরে উপকৃতই হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের মানুষের বৈষম্য কমাতে হবে। নাগরিক অধিকার ও মানবিক অধিকার রক্ষায় কাজ করতে হবে। এখন নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। এতদিন ধরে যেসব সুবিধা ভোগ করেছি, সেই সুবিধার আসক্তি থেকে বের হতে হবে। বিশ্বের কাছ থেকে বেশি সুবিধা আনতে হবে এমন মানসিকতার পরিবর্তন করে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও শক্তিশালী করতে হবে। দাঁড়াতে হবে নিজেদের পায়ে। এ জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। জোর দিতে হবে কর আহরণে মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৭ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০২১
এমআইএস/এমজেএফ