খুলনা: সুন্দরবনের খাল ও নদীতে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার কিছুতেই থামছে না। জেলে নামধারী সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা নানা ছত্রছায়ায় সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
জুন মাসে বিষ দিয়ে মাছ আহরণের ভয়াবহ চিত্রই বলে দিচ্ছে ম্যানগ্রোভ এই বনের মাছসহ জলজ প্রাণিকুলের বর্তমান অবস্থা।
প্রশাসন ও বনবিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছেন তারা। এর ফলে মৎস্য সম্পদ ও জলজ প্রাণী পড়েছে হুমকির মুখে। মাঝেমধ্যে দুই/একজন ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধী চক্র দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
সুন্দরবনের খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার অপকর্ম বেশি চলে বর্ষাকালে। অসাধু ব্যবসায়ীদের উৎকোচের বিনিময়ে বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তারা এ কাজে সহায়তা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সবশেষ, শুক্রবার (২ জুলাই) দিনগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের অধিনস্থ কাশিয়াবাদ স্টেশন ও তার আওতাধীন টহল ফাঁড়ির স্টাফরা বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৪শ কেজি চিংড়ি জব্দ ও তিনটি নৌকা, হরিণ ধরার সরঞ্জাম ও ফাঁদসহ বরফ জব্দ করা হয়েছে।
জানা গেছে, কাশিয়বাদ স্টেশন কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে কুলুখালীর ভারানী এলাকা থেকে ২৭০ কেজি বিষ প্রয়োগ করা চিংড়িসহ একটি নৌকা আটক করে। এছাড়া লঞ্চে অভিযান চালিয়ে ৬০ কেজি জেলি মিশ্রিত চিংড়ি আটক করা হয়। অন্যদিকে বজবজ বন টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. তানজিলুর রহমানের নেতৃত্বে ওইদিন রাত ১২টার দিকে খড়কুড়ি নদীতে অভিযান চালিয়ে হরিণ ধরার ফাঁদ চারটি চাকু বরফসহ হরিণ ধরার সরঞ্জাম একটি নৌকা আটক করা হয়। এ সময় বন বিভাগের অভিযান জানতে পেরে হরিণ শিকারিরা পালিয়ে যান। অপরদিকে ২ জুন রাত ১টার দিকে খাশিটানা বন টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে ছেড়ারমুখে অভিযান চালিয়ে একটি নৌকাসহ ৮৫ কেজি অবৈধ চিংড়ি জব্দ করা হয়েছে। পরে তা কয়রা উপজেলা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রট আদালতের নির্দেশক্রমে মাটিতে পুঁতে বিনষ্ট করা হয়েছে।
খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এজেডএম হাছানুর রহমান বলেন, এ ব্যাপারে বন আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষায় বন বিভাগের অভিযান চলছে।
৩০ জুন ভোরে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের দায়ে সাতজনকে আটক করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে প্রায় ১৫শ কেজি চিংড়ি জব্দ করা হয়েছে। ওইদিন ভোরে খুলনার কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দেয়াড়া ও মাদারবাড়ীয়া এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পরে জব্দ করা চিংড়ি মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
২৮ জুন কয়রায় বন-বিভাগ ও কয়রা থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুন্দরবনে বিষ দিয়ে ধরা মাছ ও বিষসহ নুরুজ্জামান গাজী নামের এক জেলেকে আটক করে বন বিভাগ। পরে তাকে মামলা দায়ের পূর্বক আদালতে সোপর্দ করেছে বনবিভাগ।
এছাড়া কয়রা থানার সদর ইউনিয়নের কাশিয়াবাদ পুলিশ ফাঁড়ির এসআই হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে সংঙ্গীয় ফোর্সসহ বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৫ নম্বর কয়রা এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ৪০ কেজি চিংড়ি রেখে দুষ্কৃতিকারীরা পালিয়ে যান। এদিকে সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল ও নদীতে বিষ দিয়ে মাছ শিকারে উদ্বেগ প্রকাশ, জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
পরিবেশ সুরক্ষায় উপকূলীয় জোটের খুলনার সদস্য সচিব এসএম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনের মৎস্য ভাণ্ডার এখন হুমকির সম্মুখীন। প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী-খাল থেকে বিষ প্রয়োগে মাছ মারা হচ্ছে। এতে শত শত মাছের প্রজাতি ধ্বংস ও মৎস্য প্রজনন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য ভাণ্ডার শূন্য হচ্ছে। সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব। আর আমরা খাচ্ছি বিষাক্ত খাবার অনুপযোগী মাছ। আমিষের চাহিদা পূরণের অফুরন্ত এ ভাণ্ডারের রক্ষণাবেক্ষণ এখন সময়ের দাবি।
গ্লোবাল খুলনার আহ্বায়ক শাহ মামুনুর রহমান তুহিন বলেন, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারে দুষ্কৃতিকারী চক্রের অবাধ তৎপরতা ক্রমেই বাড়ছে। ম্যানগ্রোভ বনের বিভিন নদ-নদী ও খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের প্রবণতায় হুমকির মুখে পড়েছে বনাঞ্চলে মৎস্য সম্পদের প্রজনন ও উৎপাদন।
অসাধু বনরক্ষীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে নির্বিচারে চলছে মৎস্য নিধনের অনৈতিক এ কারবার। জেলে নামধারী এক শ্রেণীর দুষ্কৃতিকারীদের অল্প সময়ে বেশি মাছ আহরণ কারলেও সুন্দরবনের প্রকৃত জেলেরা নিঃস্ব হচ্ছেন। আর এ কারণে বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করেছে। বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার করায় শুধু মৎস্য সম্পদই নয়, হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবনের জলজ প্রাণীও।
এদিকে মাছ শিকারের জন্য বন সংলগ্ন এলাকায় হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে বিষ বা কীটনাশক। পূর্ব-পশ্চিম বিভাগ মিলিয়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে থাকা মোট চারটি রেঞ্জের আওতাধীন ১৮টি খালে সব ধরনের জেলে প্রবেশ ও মাছ ধরার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কারণ এ নিষিদ্ধ ১৮ খালে মা মাছ ডিম ছাড়ার জন্য অবস্থান করে। সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরায় শুধু এক ধরনের মাছের ক্ষতি হচ্ছে না, অন্য প্রজাতিরও ধ্বংস হচ্ছে, এর সঙ্গে বন ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডা. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনের সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ ও পর্যটক তিন মাস বন্ধ রয়েছে। তদুপরি দুষ্কৃতিকারীরা সুযোগ পেলেই বনে প্রবেশ করে বনজ সম্পদ অবৈধভাবে আহরণের চেষ্টা করেন। গেল জুনে রেঞ্জভিত্তিক অবৈধ উদ্ধার করা বনজ সম্পদ, আটকদের নামে মামলা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৩৯টি মামলার বিপরীতে ৪৭ জন আসামির নামে মামলা করা হয়েছে।
তিনি জানান, খুলনা রেঞ্জ থেকে ১টি ট্রলার, ৩৩টি নৌকা, ১টি কাঠি জাল, ১৭টি ভেসালি জাল, ২টি খেওয়ালি জাল, ২টি খালপাটা, ২টি রকেট জাল, ৭০টি গেওয়া কচা, ৪৫ দশমিক ঘন ফুট গেওয়া জ্বালালি, ৫৮টি আটন, ৩০৫মিটার দোনদড়ি, ১৪টি ড্রাম, ১৫টি দা, ১টি সোলার প্লেট, ১ সোলার ব্যাটারি, ২টি গ্রাফি, ২টি জবাই করা হরিণ, ১৬২ মিটার হরিণ ধরা ফাঁদ, ২টি ছুরি, ২৬ দশমিক ৪৪ ঘন ফুট সুন্দরী কাঠ, ৪৮ দশমিক ঘনফুট কাকড়া জ্বালানি, ৪০টি সুন্দরী পঁচা, ৫০ দশমিক ঘনফুট সুন্দরী জ্বালানি, ৫৫০ কেজি বিষযুক্ত চিংড়ি শুটকি মাছ, ৬৩৬ কেজি চিংড়ি মাছ, (ধ্বংস/বিক্রয়), ১৯টি বিষের বোতল, ১টি হাত করাত, ৫টি ককশিট, ৩ টুকরা বরফ, ১টি মোবাইল, ৩৫ কেজি কাঁকড়া, ৫টি পাশ, ১টি মৃত বাদমী মাছরাঙ্গা, ২০০ গ্রাম সাদা বকের মাংস উদ্ধার করা হয়েছে।
এছাড়া সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে ১২ জন আসামির বিরুদ্ধে মামলার রুজু হয়েছে। এসময় জব্দ করা হয় ১০টি নৌকা, ৩টি ভেসালি জাল, ২৫০ মিটার দোনদড়ি, ১টি ভেনদি জাল
সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকে। এবার মৎস্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে এ নিষেধাজ্ঞা এক মাস বাড়িয়ে ১ জুন থেকে করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০২২
এমআরএম/এএটি