ঢাকা: আসন্ন কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা নিয়ে এবারও দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও কোরবানির চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এদিকে নানা ধরনের সঙ্কটের কথা তুলে ধরে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকারের বিভিন্ন বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে চিঠি দিচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম কমানো।
চিঠিতে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে ব্যবসায়ীরা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চামড়ার কেমিক্যালের দাম বাড়া, পুরো ইউরোপজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার আভাস, দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ও গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, দেশে বিভিন্ন দফায় গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানি ও লবণের দাম বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের সঙ্কটের কথা বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি সহজলভ্য করার দাবি রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএল-এলএফইএ) প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীন স্বাক্ষরিত পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন সংক্রান্ত একটি চিঠি বিভিন্ন দফতর-অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে তিনি বিভিন্ন সঙ্কটের কথা তুলে ধরে জানিয়েছেন, কোরবানির ঈদ সমাগত। কিন্তু বন্ড লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রাখার কারণে কারখানাসমূহ প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল আমদানি করতে পারছে না। ফলে কোরবানির সময় বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া ব্যবস্থাপনায় প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইন্ড অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আবতাফ খান বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আজকেও জুমে একটা মিটিং করেছি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে সারাদেশের চামড়া সংরক্ষণ কীভাবে হবে। এজন্য ঢাকার চামড়া ঢাকাতে ও ঢাকার বাইরের চামড়া সেখানেই লবণজাত করে সংরক্ষণ করতে হবে। গত বছরও এভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এতে অনেকটাই সফল হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আজ শুধু এ বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে। মঙ্গলবারও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়া খাতের সবাইকে নিয়ে সভা করবেন। সেখানে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হবে। দামের ক্ষেত্রে আমরা ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কারণ দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে যাতে আন্তর্জাতিক বাজার, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ, কেমিক্যাল, লেবার খরচ বেড়েছে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার, দেশে বন্যা, বৃষ্টি ও গরমের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়। আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই বেচাকেনা করবো।
চামড়ার দাম নিয়ে তিনি বলেন, সরকার কারো কথা শুনে দাম কমিয়ে দেবে না। তাহলে গত বছরই দিত। গত বছর আমরা আরও ৫ টাকা দাম কমিয়ে ধরতে বলেছিলাম কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রী সব কিছু বিবেচনা করে গরু চামড়ার দাম ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে। তাই এ বছরও সবকিছু মিলিয়ে সরকার একটা যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দেবে। যাতে ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউ যেন লোকসানে না পড়েন। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক এটা কেউ চায় না।
তিনি বলেন, এ বছর অনেক গরম। তাই চামড়া ৭ ঘণ্টার মধ্যে লবণজাত করতে হবে। তা না হলে গুণগতমান নষ্ট হয়ে যাবে। আষাঢ় মাস যখন তখন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি ও গরম চামড়ার জন্য বিষ স্বরূপ। এজন্য শত চেষ্টা করেও শতভাগ চামড়া সংরক্ষণ করতে পারি না। গত বছর বাংলাদেশে ১০ শতাংশ চামড়া পুরোপুরি নষ্ট হয়েছিল। আর গুণগতমান নষ্ট হয়েছিল ৫ শতাংশ চামড়ার। এ বছর আশা করছি গত বছরের তুলনায় কম নষ্ট হবে। সরকারসহ আমরা গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে যে কোরবানির দিন ঢাকার বাইরের চামড়া পোস্তায় না এনে যে স্থানের চামড়া সে স্থানেই লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা। আমাদের এ প্রচারণা কাজে দিয়েছে। জনগণ সচেতন হয়েছে। ফলে গত বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় চামড়া কম নষ্ট হয়েছে। তাই আশা করছি এ বছরও চামড়া কম নষ্ট হবে। গত বছরের তুলনায় এ বছর কোরবানি বেশি হবে। চামড়া সংরক্ষণ বেশি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে সারাদেশে কম দামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও চামড়ার নির্ধারিত দাম কার্যকর হয়নি।
জানা গেছে, কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা নিয়ে এবারও দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে এ খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বাজার সম্প্রসারণ, ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, পরিবেশগত মান বজায় রাখা এবং ফিনিশড লেদার উৎপাদনে সর্বোচ্চ কোয়ালিটি নির্ধারণের ওপর জোর দেয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। এ দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইতোমধ্যে খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। সেসব বৈঠকে ব্যবসায়ীরা এ শিল্প খাত বিভিন্ন নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কোরবানির চামড়ার সঠিক দাম নির্ধারণের ব্যাপারে তারা আগ্রহী নন। এ কারণে এবার কোরবানির চামড়ার দর নিয়ে দেশে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, সরকার দাম নির্ধারণের পক্ষে। এ কারণে এবারও দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। কোরবানি দাতারা যাতে না ঠকেন সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজার দরের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। চামড়ার বাজারে যাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এ চামড়ার ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ মেলে কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের ও ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। ২০২০-২১ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ।
২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুটের দাম নির্ধারণ করে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সারাদেশে খাসির চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে গত বছর ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০২২
জিসিজি/আরবি