ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

লিডিং ইউনিভার্সিটিতে বনমালীর প্রভাব, নাস্তানাবুদ ভিসি

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৩
লিডিং ইউনিভার্সিটিতে বনমালীর প্রভাব, নাস্তানাবুদ ভিসি

সিলেট: ট্রাস্টি বোর্ডের রোষানলে পড়েছেন সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) স্থপতি অধ্যাপক আজিজুল মওলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের অনিয়ম নিয়ে কথা বলায় তাদের চক্ষুশূল হয়েছেন তিনি।

যে কারণে বিদেশ সফর থেকে ফিরে নিজ কার্যালয়ে এসেও তিনি চেয়ারে বসতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তাকে বসতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দার চেয়ারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও উপাচার্যকে কোনোরকম সম্মান দেখাচ্ছেন না। কর্তৃপক্ষও তাকে দায়িত্ব পালন করতে বিরত রাখছে। আর এসব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রেজারার বনমালী ভৌমিকের প্রভাবে। তিনি এখন প্রতিষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেন।

সোমবার (১৩ মার্চ) লিডিং ইউনিভার্সিটিতে এ পরিস্থিতির শিকার হন উপাচার্য (ভিসি) স্থপতি অধ্যাপক আজিজুল মওলা। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ভিসির সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজ। অধ্যাপক আজিজুল মওলা বলেন, আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে আর্থিক অনিয়ম রোধ, একাডেমিক আপগ্রেডেশন করি, যা তাদের (ট্রাস্টি) পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে ফ্রি হ্যান্ডে ডকুমেন্ট ছাড়া টাকা নেওয়ায় বাধা দেওয়ায় আমার প্রতি তারা নাখোশ। তাই ছুটি কাটিয়ে ফেরার পর ট্রাস্টি বডি আমাকে দায়িত্ব দিতে চাচ্ছে না।

ভিসি জানান, বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজ চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালনে ৪০ লাখ টাকা খরচ করে; তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুবার্ষিকীতে কোটি টাকা খরচ করেছে। বিভিন্ন সময় ট্রাস্টি চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ টাকা তুলে নিতেন। এসব করলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি খারাপ হবে।

২০২১ সালের ১ মার্চ লিডিং ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন স্থপতি ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক আজিজুল মওলা। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দুই বছরে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে গতি আনেন। শিক্ষাক্রমের মানোন্নয়নে তিনি দায়িত্বগ্রহণের পরপরই যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেন। অভিযোগ আছে, তার গৃহীত বিশ্ববিদ্যালয় বান্ধব বিভিন্ন আইনানুগ পদক্ষেপ ট্রাস্টি বোর্ডের কিছু সদস্য ও তাদের মদদপুষ্টদের স্বার্থ পরিপন্থী হয়। যে কারণে তারা নানাভাবে ভিসিকে তার পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

গত ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন নিয়ে একটি সে‌মিনা‌রে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান ভিসি। ২৪ জানুয়ারি তার দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিকূল আবহাওয়া, এ কারণে শারীরিক অসুস্থতা, বিমানে মেডিকেল ইমার্জেন্সির কারণে একাধিকবার তার ফ্লাইট শিডিউল পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়। এসব বিষয় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে পূর্বনির্ধারিত তারিখের পরিবর্তে গত ১৬ ফেব্রুয়া‌রি দেশে ফেরেন।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার আগের দিন (১৮ ফেব্রুয়ারি) তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের সই করা একটি চিঠি ই-মেইলের মাধ্যমে পান। চিঠিতে ভিসির বিরুদ্ধে বিভিন্ন বানোয়াট/অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে অভিযুক্ত করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে নিষেধ করা হয় এবং আগামী ৬ মাস থেকে ১ বছর অবৈতনিক জরুরি ছুটি নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এমন পদক্ষেপ সুস্পষ্টভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের এখতিয়ার বহির্ভূত ও দেশের বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আজিজুল মওলা লিডিং ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যবস্থাপনা ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে পূর্বকৃত নানা অনিয়ম দেখে আইনানুগ ও জবাবদিহিতামূলক পদক্ষেপ নেন। ফলে তার ওপর তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ (বর্তমানে পুনঃ নিয়োগপ্রাপ্ত) বনমালী ভৌমিক অসন্তুষ্ট হন। অনুমোদিত নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বরাদ্দের ঘটনায় কোষাধ্যক্ষকে আইনানুগ চিঠির মাধ্যমে এ বিষয়ে জবাবদিহিতা চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হন। জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করে উল্টো চিঠি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে (তৎকালীন রেজিস্ট্রার) তার কার্যক্ষমতার এখতিয়ার বহির্ভূত উপায়ে নানা মনগড়া অভিযোগ আরোপ করে জবাবদিহিতা চান।

উপাচার্যকে না জানিয়ে এমন পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া স্পষ্ট অশোভনীয় ও দেশের বিদ্যমান আইন পরিপন্থী। যে কারণে তিনি চাকরি হারান। পরবর্তীতে বনমালী ভৌমিককে কোষাধ্যক্ষ পদে পুনঃনিয়োগ দেয় ট্রাস্টি বোর্ড। নিয়োগ পেয়েও তিনি নিয়মবহির্ভূত তহবিল বরাদ্দের যথাযথ জবাব না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য প্রয়োজনীয় ও নিয়মতান্ত্রিক অর্থ বরাদ্দের প্রক্রিয়াকে অহেতুক বাধাগ্রস্ত করে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হন।

বারান্দার চেয়ারে বসে আছেন সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) স্থপতি অধ্যাপক আজিজুল মওলাসূত্র জানায়, কোষাধ্যক্ষের এমন অবস্থান সুস্পষ্টভাবে তার পদপ্রাপ্ত ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তা শাস্তিযোগ্য। কিন্তু তিনি নিয়মের তোয়াক্কা না করেই এমন কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। ট্রাস্টি বডিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে ভিসির নেওয়া পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে প্ররোচিত করেন। ভিসির গৃহীত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপের কারণে বিভিন্ন সময়ে তৈরি হওয়া ট্রাস্টি বডির নানা অন্যায্য অসন্তোষকে কোষাধ্যক্ষ হীন উদ্দেশ্যে কাজে লাগান। ভিসির সঙ্গে ট্রাস্টি বডির দূরত্ব তৈরিতেও সক্ষম হন।

সূত্রটি আরও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম রোধে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। অথচ তিনি নিজেই আর্থিক অনিয়ম করে আইন পরিপন্থী পদক্ষেপ নেন।

জানা গেছে, ট্রাস্টি চেয়ারম্যান ও ভিসি আজিজুল মওলার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন বনমালী। তারই আদেশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভিসির পুনঃযোগদানে বাধা দেয়। তিনিই উপাচার্যের অফিস ও বাসস্থান তালাবদ্ধ করান। উপাচার্যের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ বাহন জব্দের পেছনেও তার হাত রয়েছে। এ বিষয়গুলো ভিসিকে ফোন মারফত জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এখানেই শেষ নয়, বনমালী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দাপ্তরিক ই-মেইল অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড পাল্টে দিয়েছেন। ভিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ থেকে অপসারণ করেন।

লিডিং ইউনিভার্সিটিতে শহীদ মিনার নির্মাণ করছেন শুভজিৎ চৌধুরী। তিনি বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এছাড়া তার আরেক পরিচয়, ভিসি স্থপতি অধ্যাপক আজিজুল মওলা তার শিক্ষক। দীর্ঘদিন লিডিং ইউনিভার্সিটিতে নির্মাণ কাজ করার সময় তার চোখেও প্রতিষ্ঠানটির অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে।

শুভজিৎ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ভিসি স্যার অনেক বড় গবেষক ও স্থপতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যোগদানের সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছিল। তিনি দেশের বাইরে গেলে ট্রেজারার ভারপ্রাপ্ত ভিসির দায়িত্ব পালন করেন। দেশে ফেরার পর ভিসি স্যারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু তাকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ‍তিনি রাষ্ট্রপতি মনোনীত। ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেছেন, ভিসিকে দায়িত্ব নিতে। কিন্তু তিনি এসে দেখেন তার কক্ষ তালাবদ্ধ। ভিসি স্যারকে ক্যাম্পাসে এসে বারান্দার চেয়ারে বসে থাকতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বডির কোনো আপত্তি থাকলে সেটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করতে পারেন। এভাবে দেশের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদকে অপমান করা বেমানান।  

উল্লেখ্য, গুরুতর এ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে লিডিং ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) মো. আলমগীর হোসেনকেও ফোন করা হয়। তিনি ‘পরিস্থিতি নিরসনে বৈঠক চলছে’ জানিয়ে ফোন কল কেটে দেন।

পরে লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার (অ্যাক্টিং ভিসি) বনমালী ভৌমিককেও ফোন করা হয়। তিনি ফোন কল রিসিভ করেননি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৩
এনইউ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।