ময়মনসিংহ: মাত্র ৬ ঘণ্টা আগে নতুন বই পেয়েছে বৈশাখী। বয়স ৮ কী ৯ বছর।
সন্ধ্যা হতে না হতেই ঝকঝকে চাররঙা নতুন বই নিয়ে পড়তে বসেছে। অন্যান্য দিন সন্ধ্যার পর পড়ায় মন বসে না। অথচ নতুন বছরের নতুন দিনের সন্ধ্যা একেবারেই ব্যতিক্রম।
নতুন বইয়ের পাতা উল্টানোর ফাঁকে এ সোনামণির বায়না, ‘মা, রাতেই আমাকে নতুন মলাট লাগিয়ে দেবে। স্যার মলাট লাগানো বই নিয়ে স্কুলে যেতে বলেছেন’।
মেয়ের এমন আবদারে মাথা নাড়ান মা শিরিনা আক্তার। পঁয়ত্রিশের কোঠায় তার বয়স। বই হাতে নিয়ে খুঁটে খুঁটে তিনিও দেখছিলেন সন্তানের বইয়ে নতুন কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি-না।
শুক্রবার (০১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আকুয়া ইউনিয়নের গন্দ্রপা উত্তরবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা গেলো এমন দৃশ্যের। নতুন বইয়ের ঘ্রাণে এ শিশুর চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। সন্তানের খুশিতে পরম তৃপ্তির আভা মা শিরিনার মুখাবয়বেও।
শুধু বৈশাখীদের বাড়িতেই নয়, একই গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতেই সন্ধ্যা হতেই শিশুরা দেয় মন নিজ নিজ পাঠে। বই পাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা বৈশাখীর বড় বোন রিতু আক্তার পায়েলও স্থানীয় গন্দ্রপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। দু’ বোন একসঙ্গে নতুন বই নিয়ে পড়তে বসেছে।
বৈশাখী একসঙ্গে নিয়ে বসেছে বাংলা, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ইংলিশ ফর টুডে, প্রাথমিক গণিত, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বই। তাদের বাবা লিটন ভ্যানচালক। বিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়ানো হয়নি তার। কিন্তু নতুন বই নিয়ে দু’ সন্তানের মাতামাতিতে খুশির অন্ত নেই তার মাঝেও।
‘আপনাদের সময় নতুন ক্লাসে ওঠার কতোদিন পর বই পেতেন’- জানতে চাইলে গালভরা হাসি দিলেন শিরিনা আক্তার। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘আমাদের সময় নতুন বছর শুরু হলেও নতুন বই ছিল না। এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে পুরনো বই ধার-কর্জ করে এনে পড়তো হতো। কখনো ৩ থেকে ৪ মাস সময় গড়ানোর পর দেখা মিলতো নতুন বইয়ের’।
‘আর আমাদের বয়সেই দেখলাম, আমাদের সন্তানেরা বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই পাচ্ছে। এটা তো পরম আনন্দের’।
‘আমার মা নিরক্ষর ছিলেন। আমাদের পাড়ার সব মেয়েরা দলবেঁধে নিজের ইচ্ছায় বিদ্যালয়ে যেতাম। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই বাবা বিয়ে দিয়ে দেন। এখন আমাদের দু’ সন্তানকে আমি নিজেই পড়াচ্ছি’- যোগ করেন শিরিনা।
শিরিনা আক্তারের সঙ্গে কথা শেষ করে বের হতেই কানে এলো ‘হ্যালো, হাউ আর ইউ’। দো’চালা টিনের ঘরে অশীতিপর বৃদ্ধ নানা-নানির পাশে বসে পড়ছে শিশু অনিক। একই বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে এ ক্ষুদে শিক্ষার্থী।
পাশের বাড়ির এক যুবকের কাছেই নতুন পাঠ্যবই পড়ছে অনিক। মা শাহনাজ ঢাকার গার্মেন্টেস শ্রমিক। আর বাবা থেকেও নেই। অক্ষরজ্ঞানহীন নানা-নানি চান, তাদের আদরের নাতি শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে গড়ে উঠুক। নতুন বই পেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পড়ায় মেতেছে এ শিক্ষার্থীও।
আলাপের সূত্রপাত করতেই নানি উম্মে কুলছুম বললেন, ‘আমরা তো পড়ালেহা করবার পাই নাই। আমার মেয়েডা থ্রি পাস দিছিল। ওই সময় তো ৩/৪ মাসের আগে নতুন বই পাইতো না। অহনও তো পোলাপান বছরের প্রথম দিনই বই পাইয়া যায়। দিন বদলাইছে। শেখের বেটির লেইগ্যাই এইড্যা সম্ভব হইছে’।
একই রকম দৃশ্য দেখা গেলো সুমন মিয়ার বাড়িতেও। এক ঘরে তিনি বসে টিভি দেখছেন। আর পাশের ঘরে ছোট্ট সেজুতি তার মায়ের কাছে বসে পড়ছে। বছরের প্রথম দিনেই সব বই পেয়েছে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠা এ শিক্ষার্থী।
সেজুতির মা কাজল পড়াশোনা করতে পারেননি খুব একটা। নিজের সন্তানকে দেখিয়ে দিচ্ছেন খুঁটিনাটি। ‘এ সরকার অনেক দিন ধরেই বছরের প্রথম দিনই বই দিচ্ছে। এ কারণে রেজাল্টের পর পরই মেয়ের সঙ্গে আমিও অপেক্ষায় থাকি, কবে আসবে বছরের প্রথম দিন’। হাতে পাবো নতুন বই’- উচ্ছ্বাস নিয়ে বলছিলেন মেয়ের মা কাজল।
তিনি জানালেন, রাতেই পুরাতন ক্যালেন্ডার দিয়ে মেয়ের বইয়ের মলাট বাঁধানো হবে।
বাবা সুমনও শেষ পর্যন্ত যোগ দিলেন আলাপে। এসেই বললেন, ‘ইংরেজি নববর্ষ হলো স্কুলের বাচ্চাদের বই পাওয়ার দিন। নতুন বইয়ের গন্ধে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে বাড়িতে দৌড়ে এসে বাবা-মাকে দেখানো। আমাদের সময়ে এমনটি স্বপ্নেও ভাবা যায়নি। আর এখন শিক্ষার্থীদের নতুন শ্রেণিতে ওঠার আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করেছে নতুন পাঠ্যবই’।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৬
এএসআর