ঢাকা: জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দলগুলোর মধ্যে গণভোট নিয়ে ঐকমত্য হলেও ভোটের সময় নিয়ে এখনো রাজনৈতিক মীমাংসা হয়নি। কোনো কোনো দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন এ আয়োজনের পক্ষে দাবি জানাচ্ছে।
তবে একসঙ্গে দুটি ভোট করলে নির্বাচনি ব্যয় কমে যাবে। আর ভোট গণনায় সময় লাগবে বেশি।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রগুলো জানিয়েছে, গণভোট নিয়ে সরকারের দিক থেকে কোনো নির্দেশনা না এলে বিষয়টি নিয়ে এখনই আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসছেন না তারা। তবে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন দিক নিয়ে অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময় করছেন।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, একসঙ্গে দুটি নির্বাচনে কিছু সুফল রয়েছে। এতে নতুন করে কোনো আয়োজন করতে হবে না। ফলে আলাদা করার চেয়ে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় কম হবে। কেননা, একই ভোটকেন্দ্রে কেবল কক্ষ বাড়িয়ে, একটি ব্যালট বাড়িয়ে ভোট নেওয়া যাবে। এতে ভোটকর্মকর্তার সংখ্যা কিছুটা বাড়বে। আর ব্যালট বক্স কিছু বাড়াতে হবে। তবে একসঙ্গে ভোট করলে গণনায় অনেক সময় লেগে যাবে। এতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাত ফুরিয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আলাদা দিনে করলে ভোটের পুরো আয়োজন নতুন করে করতে হবে। একই সংখ্যক ভোটকেন্দ্র, প্রশিক্ষণ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন, সব প্রায় একই রকম লাগবে। এতে প্রায় একই রকম ব্যয় গিয়ে দাঁড়াবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে গণভোটের জন্য আর ৩০০-৪০০ কোটি টাকা লাগতে পারে। আর আলাদা করে গণভোট করতে গেলে ব্যয় হতে পারে সংসদ নির্বাচনের ব্যয়ের কাছাকাছি।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, একসঙ্গে দুই ভোট করলে গণনায় কিছুটা সময় বেশি লাগতে পারে। বুথ বাড়াতে হবে এক হাজারের মতো। সেখানে অতিরিক্ত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা থাকবেন। এক্ষেত্রে গণনা যদি একসঙ্গেই করা যায়, তাহলে সময় বেশি লাগলেও অতটা লাগবে না।
তিনি বলেন, গণভোট আলাদা করলে ভোট কম পড়ার আশঙ্কাও রয়েছ। কেননা, মানুষের আগ্রহ সংসদ নির্বাচন নিয়ে। আলাদা করে গণভোট হলে ভোটারদের পরে ভোটকেন্দ্রে আনাটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।
দলগুলো কী বলছে:
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ এবং সংস্কার প্রশ্নে গণভোট একইসঙ্গে হলে নির্বাচন বিলম্বিত করার যে কোনো প্রয়াস এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তবে কেউ কেউ এটা চান না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন চ্যালেঞ্জ নয়, যারা নির্বাচন বিলম্ব করতে চায় সেটাই চ্যালেঞ্জ।
এ সময় অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গণভোট আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) দায়িত্ব দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, দুটি ব্যালট দিলে জাতি বিভ্রান্ত হবে, এমন কথা বলা হচ্ছে। অথচ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনটি ব্যালটে নির্বাচন হয়। সুতরাং জনগণ দুটি ব্যালটে সংসদ ও গণভোটে অংশ নিতে প্রস্তুত। শুধু নির্বাচন কমিশনকে প্রচারণা চালাতে হবে।
তিনি বলেন, গণভোট হবে একই দিনে। এর সুবিধা বলেছি এজন্য, জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি মহা আয়োজন। আবার গণভোটের জন্য যেন একই আয়োজন করতে না হয়। এতে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার যে কোনো প্রয়াস এড়ানো যাবে।
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আগামী নভেম্বরে গণভোটের দাবি জানিয়ে বলেছেন, গণভোট নিয়ে দুটি আলোচনা আছে। সংসদ নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একসঙ্গে হওয়ার ব্যাপারে কোনো কোনো দলের মত আছে। আমরা বলেছি, আলাদা করার জন্য যেহেতু আলাদা বিষয়। যদি আলাদাভাবে হয়, এটার জন্য প্রস্তুতি যেন রাখে (ইসি)।
তিনি আরও বলেন, সমস্যা যেটা হবে প্রত্যেকে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার বিষয়েই মনযোগ দেবে। কাজেই ওটা প্রধান্য পাবে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, কোথাও ভোট দখল হলে ওটাও দখল হবে। আমরা আলাদাভাবে করার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছি। একসঙ্গে হলে সময়ের বিষয়ও আছে। ওনারা বলেছেন, সরকার যেটা সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা সেটা বাস্তবায়ন করব।
আলাদা হলে খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা তো খুব সিম্পল। কাজেই বড় ধরনের ব্যয় হবে না। ব্যালট বাক্স তো ওটাই থাকবে। শুধু ব্যালট, খাওয়া দাওয়া এসবের ব্যয় হবে। এটা বললে স্থানীয ভোটসহ সব একসঙ্গে হতে হবে।
আলাদা হলে তো ভোট কম পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং যে সময় আছে এতে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, এমন বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি, একই দিন গণভোট হলে রিফর্মসের ইস্যু মাইনর হয়ে যাবে। কারণ সবাই নিজের দলের প্রার্থীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আরেকটা ভোটের জন্য তাকে ভোটারকে কে চাপাচাপি করতে হবে। বরং আলাদা হলে মানুষ ভোট দেবে। আবার ঝামেলা হলে আমরা তো জেনে যাবো। আর একসঙ্গে দুটি ভোট হলে এবং ঝামেলা হলে আম ছালা দুটিই যাবে। আমরা নভেম্বরে গণভোট করতে বলেছি।
তিনি বলেন, আমাদের অতীতে অনেকগুলো গণভোট হয়েছে। ২১ দিন, ১৭ দিনের তফাতেও গণভোট হয়েছে। এখানে মার্কা নেই, মিছিল মিটিংয়ের কিছু নেই। তাই সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হলে কোনো সমস্যা হবে না।
সংশ্লিষ্ট যা বলছেন:
গণভোটের দায়িত্ব পালন করেছেন, ইসির সাবেক উপ-সচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত মোট তিনটি গণভোটের আয়োজন করা হয়েছে। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি জনগণের মতামত যাচাইয়ের জন্য করেছিলেন। এতে হ্যাঁ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ। আর না ভোট পড়েছিল ১ দশমিক ১২ শতাংশ।
১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও একই কারণে গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। এতে ৯৪ দশমিক ১১ শতাংশ হ্যাঁ ভোট পড়েছিল। আর ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ পড়েছিল না ভোট।
সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর গণভোট হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল-১৯৯১-এর ওপর রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না? এ নিয়ে জনমত যাচাই হয়েছিল। এতে হ্যাঁ ভোট পড়েছিল ৮৪ শতাংশ। আর না ভোট পড়েছিল ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ।
মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, গণভোট আলাদা করলে মানুষের সম্পৃক্তরা কম থাকে। আর একসঙ্গে হলে ব্যয়ও কমে যায়।
গণভোটের সঙ্গে অতীতে সম্পৃক্ত ছিলেন ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলিও। তিনি বলেন, একদিনে নির্বাচন করলে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় অতিরিক্ত হতে পারে। আর আলাদা দিনে করলে ব্যয় প্রায় সংসদ নির্বাচনের সমানই হবে। কেননা, আয়োজন একই রকম করতে হবে।
এ বিষয়ে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, গণভোট নিয়ে আমরা এখন কিছু ভাবছি না। সরকার যখন যেভাবে বলবে, আমরা সেভাবেই আয়োজন করব।
ইইউডি/এসআই