চট্টগ্রাম থেকে : ঢাকার পর ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে বেশকিছু নাট্যদল উঠে আসে।
বন্দরনগরীতে নাট্যচর্চায় গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে বলেও মনে করেন এখানকার নাট্যশিল্পীরা। পাশাপাশি দর্শকের অংশগ্রহণও বেড়েছে। নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন, উৎসব আয়োজন ও নাট্যকর্মীদের পদচারণায় মুখর চট্টগ্রামের শিল্পকলা একাডেমি, থিয়েটার ইনস্টিটিউট, স্টুডিও থিয়েটার তথা নাটকপাড়া। নিজেদের কর্মকাণ্ড ঘিরে সুখবরই দিলেন চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা।
সোমবার (১১ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি ও বিভিন্ন মহড়াকক্ষ ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র দেখা গেছে। পাওয়া গেলো ইতিবাচক মন্তব্য। মঞ্চনাটকের সুদিন চলছে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এদিন নাটকের মহড়ার পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমির নৃত্য বিভাগের ছেলেমেয়েরা নাচের মহড়ায় অংশ নেয়। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম শিল্পকলার প্রতিদিনের চিত্র এমনই কর্মমুখর।
চট্টগ্রামে এখন নিয়মিত প্রযোজনা করছে তির্যক নাট্যদল, অরিন্দম, উত্তরাধিকার, স্বপ্নযাত্রী, গণায়ন, নান্দিকার, নান্দীমুখ, লোক থিয়েটার, মঞ্চমুকুট, কথক নাট্য সম্প্রদায়, কথক থিয়েটার প্রভৃতি নাট্যদল।
অরিন্দম নাট্যদলের প্রযোজনা ৩০টি। দলটির শেষ দুটি প্রযোজনা এখন নিয়মিত মঞ্চস্থ হচ্ছে। এগুলো হলো- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ ও চট্টগ্রামের লোককাহিনী নিয়ে ‘দুতিয়ার চাঁন’। দলটির নির্দেশক সাইফুল আলম বাবু বলেন, ‘নাটক মঞ্চায়ন ছাড়াও জাতীয় দিবসভিত্তিক বিভিন্ন আয়োজন, কর্মশালা প্রভৃতি কর্মকাণ্ড এখানে নিয়মিত হচ্ছে। আছে নাটকের দলের বর্ষপুর্তি উপলক্ষে নানা আয়োজন। ’ বাবু মনে করেন, মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চট্টগ্রামের নাট্যচর্চা আরও গতিশীল হবে। তারুণ্য নির্ভর দলগুলোতে আরও তরুণ কর্মীর আগমন ঘটবে।
উত্তরাধিকার-এর প্রতিষ্ঠা হয় ২০০২ সালে। এ পর্যন্ত সাতটি প্রযোজনা এনেছে দলটি। তাদের সবশেষ দুটি প্রযোজনা হচ্ছে আঞ্চলিক কাহিনী নিয়ে ‘সাম্পান নাইয়া’ ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর ‘দীপ্ত পাখি’। উত্তরাধিকার দলপ্রধান মোসলেম উদ্দিন শিকদার। তিনি বলেন, ‘গত বছরটা ছিলো চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীদের জন্য বেশ ভালো। অনেক প্রাপ্তি আছে ২০১৫ সালে। অনেক পুরনো দল আবার মঞ্চে ফিরেছে। ’ তিনিও মনে করেন, নাট্যকর্মীদের প্রেরণা দেওয়ার জন্য মিডিয়ার প্রচার একটু দরকার। গণমাধ্যমে ঢাকাকেন্দ্রিক প্রচারণাই বেশি চোখে পড়ে বলে মন্তব্য তার। এ বৈষম্য কমিয়ে আনা গেলে ইতিবাচক ফল আসতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্বপ্নযাত্রী নাট্যদলের অভিষেক ২০০৯ সালে। মোট আটটি নাটক মঞ্চে এনেছে দলটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘প্রেক্ষাপট’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, ‘জমিদার দর্পণ’, ‘দেশমাতার কাছে চিঠি’ প্রভৃতি। দলটির নির্দেশক শুভাশীষ শুভ বলেন, ‘বর্ষা মৌসুম ছাড়া এখানকার নাট্যচর্চা বেশ গতিশীল বলা চলে। উৎসব আয়োজনের দিক দিয়ে এখানকার নাট্যদলগুলো বেশ এগিয়ে। তিন বছর ধরে নাট্যচর্চায় নতুনমাত্রা যুক্ত হয়েছে। দেশ-বিদেশের অনেক দল ও নাট্যকর্মী এসেছেন চট্টগ্রামে। এসবই ইতিবাচক দিক। সংকটের জায়গা হলো, এখানে নতুন নাট্যকর্মী পাওয়া যায় না তেমন। আর পৃষ্ঠপোষকের অভাবও আছে। ’
কথক থিয়েটার-এর প্রতিষ্ঠাতা মো. শাহজাহান আলম। তিনি জানান, দলটির যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। এখন তারা দশম প্রযোজনার মহড়া করছেন। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি মঞ্চায়ন হবে ‘একুশের ইতিবৃত্ত’ নাটকটি। লিখেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন শোভনময় ভট্টাচার্য। শিল্পকলা একাডেমিতে মহড়ায় ছিলেন তিনি। মো. শাহজাহান বলেন, ‘চট্টগ্রামে নাট্যচর্চায় সম্ভবনার অনেক দিক আছে। সংকট বলতে, এখানে মিলনায়তন পাওয়া যায় না। ছুটির দিনে চাপ থাকে বলে মিলনায়তন পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। মঞ্চের সংখ্যা বাড়ানো গেলে নাটক চর্চায়ও গতি আসবে। ’
নাট্যকর্মীরা জানান, চট্টগ্রামের নাট্যচর্চা শুরু থেকে তারুণ্য নির্ভর। এখনও চট্টগ্রামের আশি ভাগ নাট্যকর্মীই তরুণ। তারুণ্যের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে থিয়েটারে নতুন নতুন ভাবনা ও নিরীক্ষা চলছে। চলবে...।
অসীম দাসের বিদ্যালয়ে কিছুক্ষণ
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাঙ্গন ফেইম স্কুল অব ড্যান্স, ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি সংস্কৃতি কর্মী তৈরিতে অবদান রাখছে। বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ফেইমের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক অসীম দাস।
অসীম দাস নয়াদিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত পড়েছেন এমএ ইন ড্রামাটিক আর্টস নিয়ে। সেখানে তিনি পেয়েছেন নাসিরুদ্দিন শাহ, ড. অনুরাধা কাপুর, অনামিকা হাকসার, রবীন দাসের মতো অভিজ্ঞ শিক্ষকদের। দেশে ফিরে তার মনে হয়েছিলো নিজের নাট্যজ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে। ফেইমে তার পাশে আছেন দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব কত্থক থেকে পাশ করা তিলোত্তমা সেনগুপ্তাকে। ব্যক্তিজীবনে তারা স্বামী-স্ত্রী।
চট্টগ্রামের নাট্যচর্চা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অসীম। তার মতে, ফেডারেশানভুক্ত ও এর বাইরের দলগুলোর নানা কর্মকাণ্ড এখন চোখে পড়ে। সবার মধ্যে ভালো করার একটা চেষ্টা আছে নিজের দল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার এখানে নাট্যকর্মী তৈরি হচ্ছেন। আগ্রহ নিয়ে ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। প্রতি ব্যাচে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী নেওয়া হয়। কিন্তু আবেদন জমা পড়ে অনেক। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, বিভাগীয় এই শহরটাতে নাটক বা অন্যান্য অঙ্গনে ছেলেমেয়েদের বেশ আগ্রহ আছে। এটা ইতিবাচক ব্যাপার। ’
বন্দরনগরীতে নাট্যচর্চা আরও বেগবান করার ব্যাপারে তিনি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসার পক্ষে মত দিয়েছেন। অসীম মনে করেন, দিল্লিতে যেমন টাটা বিড়লা, হোন্ডা, টিএস সিরিজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলো মঞ্চনাটক তথা সাংস্কৃতিক কাজে ভূমিকা রাখছে। এ দেশেও এমনটা হতে পারে। বড় পৃষ্ঠপোষক পাওয়া গেলে অনায়াসে বড় কাজ মঞ্চে নিয়ে আসা সম্ভব।
অসুবিধার জায়গা যে, এখানে মঞ্চকর্মীরা চাকরি বা পড়াশোনার পাশাপাশি নাটকে সময় দেন। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো ন্যূনতম পারিশ্রমিক বা সম্মানী পান না। এভাবে কাজ করার ফলে এক সময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলা স্বাভাবিক। এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
ফেইম স্কুল অব ড্যান্স, ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক যাত্রা শুরু করে ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সাল পর্যন্ত তারা শুধু বিভিন্ন কোর্স করাতেন। এরপর অালিয়ঁস ফ্রঁসেজের সঙ্গে একটা চুক্তি হয় তাদের। শুধু স্কুলের কার্যক্রম নয়, ফেইম এখন নাটকের দলও। তাদের প্রযোজনার সংখ্যা ২২। সবশেষ তারা মঞ্চে এনেছে ‘ক্যালিওগুলা’।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫
এসও/জেএইচ
** নাম নয়, বদলে যাবে চেহারা
** চট্টগ্রামে চলে না আঞ্চলিক ও আধুনিক গান
** চট্টগ্রামে ব্যান্ডসংগীতের চিত্র আশা জাগানিয়া
** শেফালী ঘোষের ভিটেমাটি ঘুরে
** চট্টগ্রামে ভেঙে ফেলা হচ্ছে আরও দুটি প্রেক্ষাগৃহ
** বন্দরনগরীতে এখনও মুনমুন