নীলফামারী: উত্তরের জনপদ নীলফামারীর সৈয়দপুর। বায়ু দূষণ ও ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় ফসলের উৎপাদন কমছে।
এতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন শিশু ও বয়স্ক লোকেরা। শীতকালে তাদের কষ্টটা আরও বেড়েছে।
একটি পৌরসভা ও পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে সৈয়দপুর উপজেলা গঠিত। উপজেলায় রয়েছে ৩২টির মতো ইটভাটা। এসব ইটভাটা থেকে প্রতিদিনই নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। যা শিশু ও বয়স্ক লোকদের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে ইটভাটা এলাকায় বসবাসকারীরা নানা সমস্যায় ভুগছেন। এছাড়া এলাকার ফলদ বৃক্ষে ফলন হচ্ছে কম। আবাদেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এলাকার লোকজন প্রতিবাদ করেও ইটভাটা স্থাপন বন্ধ করতে পারছে না।
সৈয়দপুরের কামারপুকুর ইউনিয়নের কুজিপুকুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় কয়েকটি ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটা সরকারি নির্দেশনা না মেনে নিচু করে চিমনি স্থাপন করে ইট পুড়ছে। ফলে কুণ্ডলী পাকা কালো ধোঁয়ায় শিশু ও বয়স্ক লোকেরা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আম, জাম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন গাছে মুকুল আসছে কম। ফলও আকারে ছোট হচ্ছে। আমরা এ থেকে পরিত্রাণ চাই।
ইটভাটায় মাটি বহনকারী ট্রাক, ট্রাক্টরে কোনো পলিথিন বা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকে না। ফলে এসব ট্রাকের ধুলোবালি মানুষের চোখে-মুখে পড়ছে অহরহ। মানুষ হাত দিয়ে চোখ কচলে সমস্যার সৃষ্টি করছেন চোখের।
সৈয়দপুর শহরের বাঁশবাড়ি, মিস্ত্রিপাড়া, নতুন বাবুপাড়া, বাইপাস সড়কের পাশেসহ সব মিলিয়ে ১০টির মতো গুল ফ্যাক্টরি রয়েছে। এসব গুল ফ্যাক্টরি বেশির ভাগ আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠায় তামাকের তীব্র গন্ধে রাত-দিন কাটছে এলাকাবাসীর।
তামাক ক্র্যাশ ও গুঁড়া করার কারণে নতুন কোনো লোক এসব এলাকায় আসতে পছন্দ করেন না।
এলাকার বয়োবৃদ্ধ আসমত আলী (৭৬) জানান, তামাকের গন্ধের কারণে কেউ এলাকায় আত্মীয়তা করতে চায় না। মাঝে-মধ্যে এলাকার লোকজন এসব গুল ফ্যাক্টরি উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলেও কার্যকর হয় না। এতে করে এলাকার শিশু, বয়স্ক লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অসুস্থ রোগীর রোগ আরও বাড়ছে। এসব গুল ফ্যাক্টরির মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকার মানুষ টু-শব্দটি পর্যন্ত করেন না।
সৈয়দপুরের গোলাহাট এলাকার বাসিন্দা সাজু হোসেন বলেন, আবাসিক এলাকায় গুল ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠায় মানুষের রোগ সারছে না। শিশু ও বয়স্করা কষ্ট পাচ্ছেন বেশি। শহরের বেশিরভাগ সড়ক কাঁচা থাকায় বিশেষ করে তামান্না-ওয়াপদা মোড় চার কিলোমিটার সড়ক ধুলোয় একাকার হয়ে আছে। একটি গাড়ি গেলে ধুলোয় নাক বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে শ্বাসজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এ শহরে।
শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র শিল্প কল-কারখানার টুংটাং আওয়াজ হাতুরি মারা শব্দদূষণ করে চলেছে। মেশিনপত্র চলা ও জিনিসপত্র তৈরির কারণে দিনে ও রাতে এসব কারখানায় কাজ হওয়ায় এলাকার লোকজনের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শিশুরা এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না। প্রকাশ্যে খোলা জায়গায় করা হচ্ছে ওয়েল্ডিং। রাস্তার পাশে তৈরি করা হচ্ছে ট্রাংক, বালতি। টোটকা ওষুধ বিক্রি, সভা-সমাবেশ, হারানো বিজ্ঞপ্তি, টুর্নামেন্টসহ সামান্য প্রচারের জন্য বের করা হচ্ছে মাইক। ফলে শব্দ দূষণ হচ্ছে।
সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ধীমান ভূষণ জানান, ইটভাটা পরিবেশের যেমন ক্ষতি করছে, তেমনি মানুষের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করছে কালো ধোঁয়া। এসব ইটভাটা স্থাপনে আমরা বরাবরই আপত্তি জানিয়ে থাকি। ইটভাটার কারণে ফসল উৎপাদনে ঘাটতি হচ্ছে প্রতিবছর।
সৈয়দপুরের বিশিষ্ট অ্যাজমা বিশেষজ্ঞ ডা. সিরাজুল ইসলাম জানান, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর বেশির ভাগই অ্যাজমা সমস্যায় ভুগছেন। ধুলোবালির কারণে মুখে মাস্ক পড়ছেন না। রাস্তা ও ঘরের ঝাড়ু দেওয়া ধুলোয় লোকজন আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে শীতে শ্বাসজনিত রোগীরা বড় সমস্যায় আছেন। সতর্কতাই হলো সবচেয়ে বড় চিকিৎসা। এক্ষেত্রে সবাইকে মাস্ক পড়তে হবে।
সৈয়দপুর ১০০ শয্যা হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ওয়াসিমুল বারী জয় জানান, আমাদের সচেতনতার অভাব ও প্রকৃতিতে অত্যাচার করায় বায়ু দূষণের শিকার হচ্ছে শিশুরা। শিশুদেরও শ্বাসকষ্টের কারণে নেবুলাইজার দিতে হচ্ছে। শীতকালে শিশুরা বেশি হাসপাতালে আসে এ রোগের চিকিৎসার জন্য। শিশুদের নিরাপদ রাখার জন্য ধুলোবালি ও বায়ু দূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২৫
এসআই