বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি): শত বর্ণে ও বৈচিত্র্যে বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক আর্কষণীয় একটি ফুলের নাম অর্কিড। এরা উদ্ভিদ জগতের তিনটি বড় পরিবারের অন্যতম অর্কিডেসি পরিবারের সদস্য।
একবীজ পত্রী এ উদ্ভিদের আটশ’ গণ এবং ৩৫ হাজারেরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। প্রজাতি ভেদে এদের ফুলের গঠন, আকার, আকৃতি এবং বর্ণে অনন্য বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। অনেকের মতে এ পরিবারে সর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যক উদ্ভিদ প্রজাতি বিদ্যমান। প্রাচীন চীনা গ্রন্থে তিন হাজার বছর আগে প্রথম অর্কিডকে ঔষধি উদ্ভিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অর্কিডের ইতিহাস:
উদ্ভিদবিজ্ঞানের জনক ‘থিওফ্রাস্টাস এ উদ্ভিদের নামকরণ করেন অর্কিড। অর্কিড শব্দটি গ্রীক শব্দ ‘অর্কিস’ থেকে নেওয়া। যার অর্থ অণ্ডকোষ। ইউরোপীয় অনেক স্থলজ অর্কিডের গোড়ায় অণ্ডকোষ সদৃশ দু’টি গঠন দেখা যায় বলেই হয়তো এমন নামকরণ। বর্তমানে অর্কিডের ওই দু’টি বিশেষ গঠনকে টিউবার বলা হয়। তৎকালীন সমাজে অর্কিডের মূল অংশের টিউবার নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান ছিল। অনেকেই বিশ্বাস করতেন, পুরুষের অণ্ডকোষ সদৃশ হওয়ায় এগুলোতে পুরুষত্ব বর্ধক ও উদ্দীপক জাতীয় কিছু উপদান রয়েছে। তাই পুরুষত্ব বর্ধক হিসেবে ওই সমাজে অর্কিডের চাহিদাও ছিল খুব বেশি। আবার অনেকে বিশ্বাস করতেন, প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ‘ভেনাস’ অর্কিডের ওই বিশেষ গঠনের প্রতি খুবই আসক্ত। এগুলো দেবীকে কামোদ্দীপ্ত করে। তাই যারা ওই টিউবারকে ভালবেসে ভক্ষণ করেন, দেবী তুষ্ট হয়ে তাদের পুত্র সন্তান দিয়ে থাকেন। তাই অনেকেই পুত্র সন্তান লাভের বাসনায় অর্কিডের টিউবার খেতেন।
অধিকাংশ অর্কিড বহুবর্ষজীবী হার্ব বা বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। অঙ্গজ গঠনে ব্যাপক বিভিন্নতা থাকলেও ফুলের গঠনের সামঞ্জস্যতা এসব উদ্ভিদকে একই পরিবারভুক্ত করেছে। অর্কিডের কিছু বিশেষায়িত বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেমন-এরা টেরিস্ট্রিয়াল, ইপিফাইট, স্যাপ্রোফাইট বা ক্লাইমবার হয়ে থাকে। এদের মুল ফ্লেশি বা রাইজোমেটাস। মূলে ভ্যালামেন টিস্যু থাকে। এ টিস্যুর সাহায্যে বাতাস থেকে এ উদ্ভিদ পানি শোষণ করে বেঁচে থাকে। ফুলের উপরাংশ নিচের দিকে হয়ে থাকে। এর ফুলে তিনটি বৃতি ও তিনটি পাপড়ি থাকে। একটি পাপড়ি বড় ও বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। বর্ণ ও বৈচিত্র্যে ফুলগুলো খুবই আকর্ষণীয় হয়।
বর্তমান বিশ্বে অর্কিড:
অর্কিড বর্তমান বিশ্বে অর্নামেন্টাল উদ্ভিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। খাদ্য, খাদ্য সহায়ক, ওষুধ, ঔষধি উপাদান, পানীয় উপাদান, পানীয় সহায়ক, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট, অভ্যন্তরীণ সজ্জায়নসহ বিশ্বে অর্কিডের রয়েছে বহুবিধ অভিজাত ব্যবহার।
পশ্চিমা বিশ্বের অনেক স্থানেই দেখা যায়, তারা অর্কিডের ওপর কোনো গ্রন্থ লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেন, অর্কিড সর্ববৃহৎ উদ্ভিদ পরিবার হলেও এর মধ্যে শুধু ভ্যানিলা এবং অর্কিস প্রজাতি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ উক্তিকে অনেকেই এখন ব্যঙ্গাত্মকভাবে দেখছেন। কারণ, একথা আজ প্রমাণিত সত্য যে প্রতি একক আয়তনে উৎপন্ন লাভজনক উদ্ভিদের মধ্যে অর্কিডই প্রথম স্থানের অধিকারী।
ইউরোপিয়ান রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, আফ্রিকানরা শত শত বছর আগে অর্কিডকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতেন। তারা প্রধানত Euloptia এবং Oeceoclades প্রজাতির অর্কিড খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন।
সম্প্রতি জীববিজ্ঞানিরা গবেষণায় দেখেছেন, আফ্রিকানরা প্রায় ৭৭ প্রজাতির অর্কিড খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। Disa, Habenaria এবং Satyrium গণভূক্ত অর্কিড বেশি ব্যবহৃত হয়।
জাম্বিয়াতে এসব অর্কিড দুষ্প্রাপ্য হয়ে পরায়, তারা পার্শ্ববর্তী দেশ তাঞ্জানিয়া থেকে অবৈধভাবে তা আমদানি করতে থাকে। নিরূপায় হয়ে তাঞ্জানিয়া সরকার তাদের ‘কিটুলো’ অঞ্চলকে জাতীয় পার্ক (সংরক্ষিত এলাকা) হিসেবে ঘোষণা করে এবং ওই অঞ্চলের অর্কিড প্রজাতিগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ভ্যানিলা বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত অর্কিড। ফ্লেভার বা সুঘ্রাণ খাদ্যের ও পানীয়ের মান বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। কিউবাতে ভ্যানিলার সুঘ্রান তামাকজাত খাদ্যোপাদানকে আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয়।
শুধু তাই নয়, ১৬-১৯ শতক পর্যন্ত প্রায় তিনশ’ বছর কামোদ্দীপক ও থেরাপিতে অর্কিড ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও অনেক অর্কিড মাথা ব্যাথা দূরীকরণে, বিষাক্ত পোকার দংশনে উপশম হিসেবে এবং পেটের পিড়ায় ওষুধ হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে বহুকাল ধরে।
সম্প্রতি কিছু গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ভ্যানিলার ফ্লেভার কেমোথেরাপি দেওয়া রোগীদের খাদ্য গ্রহণ বৃদ্ধি করে এবং অবসাদ দূর করে বমি বমি ভাব থেকে মুক্ত করে।
সম্প্রতি গবেষক ফ্ল্যাডবাই ও তার সহকারীরা প্রমাণ করেছেন, আলজেইমার রোগ সনাক্তকরণে ভ্যানিলা ব্যবহার করা যায়, কারণ এ রোগে আক্রান্ত রোগী ভ্যানিলার গন্ধ সহ্য করতে পারে না।
খাদ্য হিসেবে অর্কিড:
ভ্যানিলা অর্কিডের অনেক ফুলই সরাসরি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডেনড্রোবিয়াম গণভুক্ত অর্কিড ‘‘ফুড-অর্কিড’’ হিসেবে খ্যাত। আমেরিকায় হাইব্রিড ডেনড্রোবিয়াম অর্কিডের ফুল খাদ্যে ডেকোরেশন করতে ব্যবহৃত হয়। এশিয়ার অনেক দেশে হালকা পানীয় ক্যানে এ ফুল চিত্রাকর্ষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জাপান ও সিঙ্গাপুরে সস তৈরিতে ডেনড্রোবিয়াম ব্যবহার করা হয়। আয়ারল্যান্ডে এ জাতের ফুল বাটারের সঙ্গে ফ্রাই করে সুস্বাদু খাবার তৈরি করা হয়। ইউরোপে ডেজার্ট এবং কেকে এ ফুল ব্যবহার করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা অনেক আগে থেকেই Dendrobium kingianum উদ্ভিদের সিউডো-বাল্বকে (কাণ্ডের গোড়ার ফোলা অংশ) উপাদেয় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আসছেন।
Dendrobium, Speciosum, Gastrodia, Sesamoides এবং Caladenia প্রজাতির অর্কিডকে অস্ট্রেলিয়ার অনেক উপজাতি আপদকালীন প্রতিরক্ষায় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। Diuris maculata অর্কিডের টিউবার মিষ্টি স্বাদের ও প্রতিটি টিউবার আমেরিকার অভিজাত এলাকায় প্রায় ৩০ ডলারে বিক্রি করা হয়। চীনে Dendrobium cathenatum টিনজাত করা হয় এবং উষ্ণচায়ের সঙ্গে পান করা হয় প্রধানত অসুস্থতার পর বা যৌন মিলনের পর। নেপালে Dendrobium chrysotoxumসহ কিছু প্রজাতির অর্কিড ফুলসমূহ শুকিয়ে চায়ের সঙ্গে খাওয়া হয় সুস্বাস্থ্যের আশায়। নেপালের তামিল অধ্যুষিত এলাকায় Dendrobium longicornu অর্কিডের ফুল দিয়ে উপাদেয় আচার বানানো হয়। গ্রামাঞ্চলে অনেক অকির্ডের সিউডো-বাল্ব এবং টিউবার তৃষ্ণা নিবারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি হাওয়াই দীপপুঞ্জে অর্কিড বিভিন্নভাবে খাদ্য হিসেবে প্রচলিত, বিশেষ করে খাদ্য ভাণ্ডর ডেকোরেশনে এবং খাবার প্লেট ডেকোরেশনে বিভিন্ন হোটেলে ও রেস্তোরায় অর্কিডের কদর অনেক। এছাড়া সালাদ হিসেবে খাদ্যের ডিশে অর্কিড ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে। সুগার কোটেড করে অর্কিড দিয়ে বিভন্ন স্বাদের মূল্যবান ক্যান্ডি তৈরি হচ্ছে। কোনো অর্কিডই বিষাক্ত নয়। তাই খাদ্য পরিবেশনায়- রকমারিকরণে, সহায়ক স্বাদের সংযোজনে এবং খাদ্য পরিবেশনায় অর্কিড দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
কোমল পানীয় ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অর্কিড:
পানীয় জগতে অর্কিডের ব্যবহার ব্যাপক। মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে টার্কিতে স্থলজ অর্কিডের টিউবার থেকে ‘সাহলেপ’ নামক আইসক্রিম ও পানীয় প্রস্তুত করা হয়। আরবি সাহলেপ শব্দটি ইংরেজিতে ‘সালেপ’ শব্দে প্রচলিত হয়েছে। ‘সালেপ’ স্টার্চ সমৃদ্ধ মিষ্টি উপাদান। এটি রুটিতে মিশিয়ে খাওয়া যায়, আবার পানীয়তে মিশিয়েও খাওয়া যায়। ঐতিহ্যগতভাবে এটি পুষ্টি সমৃদ্ধ এবং ভ্রমণকারীদের দুপুরের খাবারের বিকল্প হিসেবে ‘সালেপ’ গ্রহণ করা হয়। টার্কিতে Anacamptis morio এবং একই শ্রেণীভুক্ত Orchis masculata প্রজাতি থেকে ‘সালেপ’ প্রস্তুত করা হয়। টার্কিরা সালেপের ঔষধি গুণাগুণ সম্পর্কে প্রথম অবগত হন ইংল্যান্ড থেকে। ১৫৬৮ সালে উইলিয়াম টারনার নামে বিখ্যাত হার্বালিস্ট অর্কিডের চারটি ঔষধি গুণাগুণ প্রচার করেন। এগুলো হলো এন্টি-পাইরেটিক, এন্টি-কনজ্যামশন, এন্টি-ডায়ারিয়া এবং এন্টি-এলকোহলিক গ্যাসট্রাইটিস।
১৬৪০ সালে বিখ্যাত চিকিৎসক জন পার্কিনসন বলেন, অর্কিড জাতীয় খাদ্য মানব দেহে পুনঃউৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। উনিশ শতকে ÔBourbon teaÕ পশ্চিমা দেশগুলোতে খুবই জনপ্রিয় ছিল। ওই চায়ে এক প্রকার অর্কিড মেশানো হতো। মনে করা হতো, ওই চা এক ধরনের ‘সিডেটিভ’ গুণ সম্পন্ন এবং তাতে ‘জুমেলিয়া’ নামক সুগন্ধী পাওয়া যেত। দক্ষিণ আফ্রিকান অঞ্চলের তাঞ্জানিয়া, জাম্বিয়া এবং মলাবিতে সুদীর্ঘকাল ধরে অর্কিডের টিউবার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে অর্কিড টিউবার বাণিজ্যিকভাবেও ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। টিউবার দিয়ে তৈরি খাদ্যকে তারা মাংসের স্থলাভিষিক্ত মনে করতেন। এ ব্যবসা ব্যাপক হওয়ায় একপর্যায়ে এ অঞ্চলে অর্কিড নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়।
অর্কিড প্রেমিকদের এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে অর্কিড উৎপাদনকারীদের মতে, অর্কিড উপাদেয় ফাইবার ও ভিটামিন যুক্ত খাবার। এ খাবারের স্বাদ কেমন তার এক জরিপে অনেক মতামত পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, কিছুটা মিষ্টি স্বাদের অর্কিড খুবই ভালো লাগে। কেউ আবার বলেছেন, এদের স্বাদ কিছুটা ট্যানিন যুক্ত খাবারের মতো। আবার কেউ বলেন, খাদ্য হিসেবে এটি তাদের পছন্দের সর্বশেষ তালিকায়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ওবায়েদুল ইসলাম অর্কিডের প্রজনন, বিস্তার ও টিস্যু কালচারের ওপর গবেষণা করছেন। গবেষণার জন্য তিনি ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের টিস্যু কালচার গবেষণাগারে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্কিডের প্রজনন করছেন।
ওপরে উল্লেখ করা তথ্যগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, বাকৃবির বোটানিক্যাল গার্ডেনের একটি অংশই রয়েছে অর্কিডের জন্য। গবেষণাগারে যেসব অর্কিড কালচার করা হয়, তা গার্ডেনের ওই অংশে রোপণ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে অর্কিডের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অর্কিড চাষাবাদের মাধ্যমে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিসহ বেকারদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৩
সম্পাদনা: শিমুল সুলতানা, অ্যাক্টিং কান্ট্রি এডিটর [email protected]