ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

মেঘনার ঢেউয়ে ওয়াজিউল্লাহের আহাজারি

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩
মেঘনার ঢেউয়ে ওয়াজিউল্লাহের আহাজারি

কাছিয়া (ভোলা) থেকে: বাড়ির কথা জানতে চাইলে সত্তরোর্ধ ওয়াজিউল্লাহ খাঁ ভয়াল মেঘনার দিকে আঙ্গুল তুলে ছলছল চোখে বললেন, ওইখানে মোর বাড়ি ছিল। এখন কিছুই নাই।

ভাঙনের তাড়া খেয়ে শুধুু পালাই। বছরে কতবার যে পালাতে হয় তার হিসাব নাই। ভাঙন কাছে এগিয়ে এলে বাড়ি সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজি।

নদীর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে এখনও পুরোনো ভিটেমাটি খুঁজে ফেরেন বৃদ্ধ ওয়াজিউল্লাহ। আঙ্গুল তুলে বোঝানোর চেষ্টা করেন এ নদীতে ছিল তার বাড়িঘর। অথচ এখন সেই ভুখন্ড জুড়ে শুধু পানি আর পানি।

তবুও তারই মধ্যে দূরের একটি জায়গায় আঙ্গুল দিয়ে সীমারেখা টানার চেষ্টা করেন। যে জায়গাটায় এক সময় ছিল তার ঘর-গেরস্থলি। এখন সেই ঘর রাক্ষুসে মেঘনার অতলে। বারবার ঘর বাঁধেন একটু এগিয়ে। কিন্তু কদিনের মধ্যেই আবার বিলীন।

এক সময় সচ্ছল পরিবারের কর্তাব্যক্তি ছিলেন সেকথা তার চেহারা আর কথাই বলে দেয়। গ্রামের বিচার-সালিশি করতেন। এলাকায় সাবেক মেম্বার হিসেবে পরিচিতি আছে। বাবার পথ ধরেই ছেলে মনির হোসেন আবার এলাকার মেম্বারের দায়িত্ব পেয়েছেন। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়লেও ওয়াজিউল্লাহ এখনও এলাকার খোঁজ রাখেন। জীবিকার তাগিদে এখনও তাকে যেতে হয় বাইরে। ভাবতে হয় পরিবারের কথা।

ওয়াজিউল্লাহ একা নন। এ মিছিল অনেক দীর্ঘ। কালিকানগরে আলাপের সময় নিজেদের কষ্টের কথা জানাতে এগিয়ে এলেন কামাল, বজলু মাল, মোসলেহউদ্দিন, ফরিদ আহমেদ, জয়নব বিবি, বিলকিস বেগমসহ আরও অনেকে।

একটু পরে সন্ধ্যা নামবে। পড়ে আছে অনেক কাজ। তারপরেও একটু আকুতি জানাতে বহু মানুষের ভিড় জমে। যেন নামটা লেখাতে পারলেই মিলবে কিছু সাহায্য। এ মানুষগুলোর দাবি পূনর্বাসন আর ভাঙন রোধ।

ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে কাছিয়া ইউনিয়নের কালিকানগর কাঠির মাথা নামক স্থানে কথা হচ্ছিল ভয়াল মেঘনার ভাঙনে বিপন্ন মানুষের সঙ্গে। জেলা শহর থেকে ইলিশা ফেরিঘাটের দিকে চলে যাওয়া সড়কটির শাখা হয়ে পরানগঞ্জ থেকে আরেকটি সরু সড়ক এগিয়েছে কালিকানগরের দিকে।

পথে যেতে যেতেই দুর্যোগের ক্ষতচিহ্ন। বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ সবখানেই প্লাবনের চিহ্ন। ফসলি মাঠ এখনও ডুবে আছে জোয়ারের পানিতে। কোমর পানিতে ডুবে থাকা পিচঢালা সড়কটি কোনোভাবে চলাচলের উপযোগী করা হলেও তা দিয়ে যানবাহন চলাচল কষ্টসাধ্য।

পিচঢালা সড়কটি কালিকানগরে গিয়ে থেমেছে। এরপরে আরও অনেক দূর অবধি এ সড়ক গেলেও তা এখন মেঘনার গভীরে, জানালেন এলাকার লোকজন। এতটা কষ্টকর জীবন, বারবার বাড়ি বদল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা স্থানান্তর, তারপরও জীবন থেমে থাকে না।

জীবনের প্রয়োজনে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষগুলো ছুটছে কাজে। ঘরবাড়ি হারিয়েও মেঘনায় মাছধরা আর মাছের ব্যবসাকেন্দ্রিক জীবন এ ভাঙন বিপন্ন মানুষগুলোকে জাগিয়ে রাখে। এমন দৃশ্যই চোখে পড়লো কালিকানগরে।

‘দুইশ, দুইশ পাঁচ, দুইশ দশ, তিনশ, তিনশ পাঁচ’ পড়ন্ত বিকেলে কালিকানগরের জেলে কফিল উদ্দিন এভাবেই ইলিশ মাছের দর হাঁকছিলেন। হাঁকতে হাঁকতে দর উঠতে থাকে। এক সময় মাছ বেচাকেনা শেষ হয়।

আবার নদীতে জাল ফেলা। ভাঙনের ভয়। যেকোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে মাইলের পর মাইল। তবে সেটা অনেকটাই এখানকার মানুষের গা সওয়া। এক একজন ভাঙন কবলিত মানুষের অবস্থার বর্ণনা থেকে সেটাই স্পষ্টই বোঝা যায়। ভয়াল মেঘনার তাড়া খেয়েও যেন এখানেই তাদের জীবিকা। যেন মেঘনার তীর ঘেঁষেই জীবন কাটাতে হবে তাদের।

কালিকানগরের ক্ষুদ্র দোকানদার মাইনুদ্দিন একেবারেই সহজ করেই বললেন গতমাসে ছয়বার দোকানের জায়গা বদল করেছেন। জোয়ারের পানির ভয়ে দোকানটি বেশ উঁচু করে বানিয়েছেন। এখন আবারও তা ভাঙনের কিনারে পৌঁছেছে। আবারও স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুতি। জানালেন এ অবধি ১২৩ বার দোকানটি স্থানান্তর করেছেন তিনি। অথচ এক সময় বেশ সম্পদ ছিল মাইনুদ্দিনের বাবার।

স্থানীয় লোকজনের দেওয়া তথ্যমতে, ভোলা সদর উপজেলার দনিয়া ইউনিয়নের তুলাতলী থেকে শুরু করে ইলিশা ইউনিয়নের জংশন অবধি মেঘনার তীরে প্রায় ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ না থাকায় এবার প্রবল জোয়ারের পানিতে গোটা এলাকা ডুবে যায়।
    
গত বছর ধরে এ অবস্থা। তবে এবারের অবস্থা বেশি খারাপ। বয়সী ব্যক্তিরা জানালেন তাদের জীবদশ্যায় মেঘনা প্রায় ৫০ কিলোমিটার ভেঙে কালিকানগরের এ স্থানে এসেছে। আগে ভাঙনের মাত্রা কিছুটা কম থাকলেও ক্রমে তা বাড়ছে।

গত ২-৩ বছর এ মাত্রা অনেক বেড়েছে। ভাঙন গোটা এলাকার জীবনযাত্রা লন্ডভন্ড করে দেয়। বদলে দেয় পেশা। পাল্টে যায় জীবিকার ধরন। তবুও মানুষগুলো নদীর তীর ঘিরে থাকে। কারণ এখানেই তাদের জীবিকা।

ভাঙনের কারণে কাছিয়া ইউনিয়নের কালিকানগরের এ এলাকায় একটি হাইস্কুল, চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি মাদ্রাসা স্থানান্তর করতে হয়েছে। খরকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি শুধু সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্থানান্তরের জায়গা না পাওয়ায় চেয়ারটেবিল ছাড়াও আসবাবপত্র রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেলো।

বিদ্যালয়ের অনেক কাগজপত্রই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অভিভাবকেরা জানালেন, ভাঙনের কারণে বহু ছেলেমেয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রেই নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। অথচ মন্ত্রী-এমপিদের খুব একটা দেখা মেলে না এসব দুর্গত জনজীবনের এলাকায়।

ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষেরা বলছেন, জুন-জুলাই থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর অবধি এ এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা থাকে। আমাবস্যা-পূর্ণিমার জো-তে তলিয়ে যায় বাড়িঘর, দোকানপাট, ফসলি মাঠ সবকিছু।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ভাঙনের তীব্রতা সত্ত্বেও ভাঙনরোধে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। এলাকাবাসীর ভাষায়, ভাঙন ঠেকাতে অর্থ বরাদ্দ, কাজও হয়। কিন্তু সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দৃশ্যমান হয় না। শুনলাম ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ হইলো। ২০ হাজার টাকার কাজ হতে না হতেই কাজ শেষ। এমন কাজ হলে তো কোনোদিনই ভাঙন রোধ হবে না।

ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ বিভিন্নভাবে বেড়িবাঁধের কাজে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ সহায়তা না পাওয়া। অনেকে আবার সাহায্য বিতরণে দলীয়করণের সুস্পষ্ট অভিযোগের কথা জানালেন।

ভাঙন দুর্গত পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, তার ইউনিয়নে আট কিলোমিটার বাঁধ নেই। ৩৫ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সাহায্য তেমনটা মেলেনি। সাহায্যের হিসাবে তার ইউনিয়নে ১৪ লাখ টাকা আর ১৪০ টন চাল দেওয়া হলেও তা বিতরণে দলীয়করণের ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন।

ভাঙন কবলিত আরেকটি ইউনিয়ন ধনিয়ার চেয়ারম্যান ইমদাদ হোসেন কবির বাংলানিউজকে বলেন, তার ইউনিয়নে দুই কিলোমিটার বাঁধ নেই। সেখানে তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত। সাহায্য হিসাবে যা বরাদ্দ মিলেছে, তা বিতরণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।