রায়পুর, লক্ষীপুর: কচুরিপানা ভর্তি ছোট্ট খাল। এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে লক্ষীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার ভেতর দিয়ে।
এ হচ্ছে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের এখনকার অবস্থা। মেঘনা তীরবর্তী এ অঞ্চলের পানি সেচ, পানি নিষ্কাশন আর বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে স্বাধীনতাত্তোর কালে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও এখন তা অভিভাবকহীন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কর্মকর্তাই মাঠে আসেন না। প্রকল্পের মাঠ কার্যালয়গুলো প্রায় পরিত্যক্ত। প্রকল্পের অধীনে খাল ছাড়াও স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কোনো সুব্যবস্থা নেই।
তবে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জীবন কৃষ্ণ দাস বাংলানিউজের প্রশ্নের জবাবে এ অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে বলেন, প্রকল্প সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্পের কর্মীরা মাঠে যান। পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে খালগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। তবে পর্যায়ক্রমে খালগুলো কেটে ফেলা হবে।
চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের লক্ষীপুর সদর, রায়পুর ও চাঁদপুরের হাইমচরের প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাঁধ এলাকা সরেজমিনে ঘুরে প্রকল্পের দুর্দশা চোখে পড়ে। কৃষকেরা অভিযোগ করেন, এক সময় এলাকার মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি এখন এলাকাবাসীর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বোরো চাষে সেচ দেওয়াকে প্রধান লক্ষ্য ধরে প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে ১৫ বছরে অন্তত ২৫ ভাগ বোরো আবাদ কমে গেছে। বিনা সেচের ফসল হিসেবে সয়াবিন লাভজনক হওয়ায় কৃষকেরা এখন এ ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন।
সেচ প্রকল্পের আওতাভূক্ত রায়পুরের চর আবাবিল এলাকার বাসিন্দা তসলিম উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের ভেতরে নিচু জমিতে অতিবৃষ্টিতে পানি জমে। বীজতলা নষ্ট হয়। প্রকল্পের ভেতরে খালে মাছ চাষ করায় আমন মৌসুমে সমস্যা দেখা দেয়। ২-৩ কিলোমিটারের ব্যবধানে মাছচাষ বিঘিœত হয়। শুকনো মৌসুমে খালের পানি একেবারেই কমে যায়।
পশ্চিম লক্ষীপুর গ্রামের ষাট বছর বয়সী কৃষক হারিছ মিয়া বলেন, এ প্রকল্প আমাগো শেষ করে দিছে। জমিজমা যা ছিল সব গেছে প্রজেক্টে। আছে সামান্য চাষের জমি। তাতেও আবার আবাদ করতে নানা ধরনের সমস্যা। একই গ্রামের আরশাদ আলী, রুহুল আমীন সবারই একই অভিযোগ। অভিযোগে তারা বলেন, মাছ চাষের কারণে খালের অনেক সমস্যা তৈরি হয়। খাল লিজ নিয়ে যারা মাছ চাষ করে, তারা মনে করে খালের মালিক তারাই।
চর রুহিতা ইউনিয়নের দক্ষিণ চর রুহিতা বড়ইতলা গ্রামের চাষের দোকানে কজন কৃষকের আড্ডা। মো. আলম, মো, শাহজাহান, ফরিদ উদ্দিন ভূইয়া, মো. শফিক, মো. আলমগীরের অভিযোগ, আমরা নদীর পাড়ের বাসিন্দা। অথচ নদী আমাদের ব্যবহারের সুযোগ নেই। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সে দলের নেতারা খাল নিয়ন্ত্রণ করে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অতিবৃষ্টিতে পুরো এলাকা ডুবে যায়। মার খায় ফসল।
প্রকল্পের সুবিধা-অসুবিধা দুদিক সম্পর্কেই বাংলানিউজের কাছে ব্যাখ্যা দিলেন দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ হাওলাদার। তিনি বলেন, বেড়ি কিংবা খালের পাশে বসবাসকারীরা সুবিধাভোগী হলেও খালের আধিপত্য থাকে প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে। হাজীপাড়া সøুইজগেট থেকে চর রুহিতা অবধি প্রায় ৫ কিলোমিটার খাল ভরাট। খালের পানির প্রবাহও কম। এসব সমস্যা প্রকল্পকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাজীপাড়া সুইজগেটের মুখে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে এ এলাকায় লোকজন নদীর ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করে। খালের কোনো কোনো এলাকা থেকে বালি তোলা হয়। ফলে দুতীরে ভাঙন দেখা দেয়। এমনকি দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের চর কাছিয়া এলাকায় প্রকল্পের মূল বাঁধ মেঘনার ভাঙনের হুমকির মুখে। ভাঙন চলে এসেছে ৩০০ মিটারের মধ্যে।
রায়পুর উপেজলা কৃষি কর্মকর্তা ড. এ. কে. এম শামীম আলম বাংলানিউজকে বলেন, সংস্কারের অভাবে সেচ প্রকল্পের ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ড্রেনের আশপাশে বাড়িঘর হয়ে যাওয়ায় ড্রেনগুলো সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে সুইজগেটের একপাশ দিয়ে পানি প্রবেশ করায় সমস্যা দেখা দেয়। প্রকল্পের ড্রেনগুলো পুনসংস্কার প্রয়োজন। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করলে সেচ প্রকল্প থেকে কৃষকেরা আরও উপকৃত হতে পারে।
সূত্র বলছে, চাঁদপুর ও লক্ষীপুরের ছয় উপজেলা জুড়ে আছে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প। লক্ষীপুর সদরের আংশিক, রায়পুরের পুরোটা, রামগঞ্জের আংশিক, ফরিদগঞ্জের পুরোটা, চাঁদপুর সদরের আংশিক এবং হাইমচরের পুরোটা নিয়ে প্রকল্প জুড়ে আছে ১০০ কিলোমিটার বাঁধ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বাস্তবায়িত এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল পানি সেচ, পানি নিষ্কাশন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ। প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এ প্রকল্পে সুবিধাভোগীর তালিকায়। পাঁচ লক্ষাধিক কৃষকের ৫৭ হাজার হেক্টর জমি আছে প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পের ভেতরে বোরো স্কিম আছে দেড় হাজার। পাকিস্তান আমলের ডিজাইনে বাস্তবায়িত এ প্রকল্প ১৯৭৫ সাল থেকেই কৃষকদের সেচ সুবিধা দিয়ে আসছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ব্যক্তিরা এবং প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্যমতে, এ প্রকল্প থেকে কৃষকেরা ১৯৮৪-৮৫ সাল অবধি মোটামুটি সেচ সুবিধা পেয়েছে। এরপর থেকেই সেচ সংকট শুরু হতে থাকে। সেচের পানি পেতে নানা সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। এ কারণে কৃষকেরা বোরো চাষাবাদ থেকে সরে যেতে শুরু করে। বর্তমানে এ প্রকল্পের মাঠের কোনো প্রশাসনিক কার্যক্রম নেই।
জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের রায়পুর কার্যালয়টি রায়পুর, রামগঞ্জ ও লক্ষীপুর সদরকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এ এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দেখা যায় না। কর্মকর্তারা অফিস করেন না। ফলে কৃষকেরা অভিযোগ জানানোর মত কোনো জায়গা পাচ্ছে না।
প্রকল্পের ২০টি স্থানে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার স্থাপনা অযতেœ পড়ে আছে। চাঁদপুরে বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী যোগদানের চার বছরে এ এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কর্মকর্তাকে মাঠপর্যায়ে দেখা যায়নি। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় এ বিভাগের কাউকে পাঁচ বছরেও দেখা যায়নি। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তো আছেই।
রায়পুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যালয় থাকলেও সেখানে সরেজমিনে কোনো কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। এ কার্যালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান। চাঁদপুরের একটি প্রকল্পের দায়িত্ব থাকায় তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। রায়পুরে খুব একটা আসেন না। এ কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আলাউদ্দিনও থাকেন চাঁদপুরে। কাজ থাকলে তবেই আসেন রায়পুরে।
অভিযোগ অস্বীকার করে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান বাংলানিউজকে বলেন, আমি প্রয়োজন হলে রায়পুরে যাই। তবে মাঠ পর্যায়ে আমাদের লোকজন কাজ করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৩
আরআই/এসএইচ/জিসিপি