ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

মেঘনা সব লই যায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৩
মেঘনা সব লই যায়

আলেকজান্ডার, রামগতি, লক্ষ্মীপুর: মেঘনা সব লই যায়। আঙগো দু:খ দ্যাহার লাই কেউ আইয়ে না।

বারবার নদী ভাঙনের শিকার মো. সিরাজউদ্দিন এভাবেই নিজের কষ্ট প্রকাশ করলেন। রামগতির আলেকজান্ডার ইউনিয়নের দক্ষিণ আসলপাড়ার এ বাসিন্দা নদী ভাঙনে সব হারিয়ে একটি ছোট্ট দোকান নিয়ে বসেছেন। এতেই কোনো মতে সংসার চলে।

আশ্বিনের সকাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝে জেলেদের ব্যস্ততা। কেউ জাল মেরামত করছে, কেউবা মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রামগতির আলেকজান্ডার বাজারের নিকটে দক্ষিণ আসলপাড়ার খালে ভিড়েছে অনেকগুলো মাছধরা ট্রলার। মেঘনা তীরে মাছঘাটে চলছে ইলিশের দর হাকাহাকি। ইলিশ বিক্রি করে কিছু জেলে আবার চাল-ডাল, তেল-নুন নিয়ে বাসায় ফিরছে।

m2সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা গেল, রামগতির আলেকজান্ডার আর কমলনগরের মাছের হাটগুলোর অবস্থা মোটামুটি একই রকম। এলাকার বহু মানুষের জীবিকা মাছধরার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় মাছের মৌসুমে ঘাটগুলো থাকে জমজমাট।

কিন্তু অন্য মৌসুমে অনেকে কাজের সন্ধানে শহরে ছুটে। জীবিকা নির্বাহের এ সংকটের সঙ্গে এখানকার প্রায় প্রতিটি মানুষকে তাড়িয়ে ফেরে নদী ভাঙন। মেঘনা ভেঙে নিয়ে যায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। সম্পন্ন গৃহস্থরা সব হারিয়ে রাস্তায় বসে যায়।

দক্ষিণ আসলপাড়া ঘাটে সিরাজউদ্দিনের দেওয়া তথ্য হুবহু মিলে যায় আলেকজান্ডারের কয়েকটি এলাকা সরেজমিন ঘুরে। মেঘনা তীরের বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়ে বাড়িঘর স্থানান্তরের দৃশ্যপট। বাড়ির পাকা বৈঠকখানা ভেঙে ফেলা হচ্ছে।

কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ভিটের মাটি তুলে নেওয়া হচ্ছে। সুপারি গাছ, নারিকেল গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ভাঙনের তীরে থাকা প্রিয় স্বজনের কবরস্থানের পাশে এসে শেষবারের মতো দাঁড়াচ্ছেন নিকটজনেরা। এগুলো আলেকজান্ডারের মেঘনাপাড়ের খুব চেনা দৃশ্যপট।

আলেকজান্ডার ইউনিয়নের উত্তর সেবাগ্রামের ছোট্ট একটি দোকানে অনেকের ভিড়। ভাঙনের শিকার মানুষগুলো কর্মহীন সময় কাটাচ্ছিলেন। সাউন্ডবক্সে হিন্দি গানের জোরালো আওয়াজ কানে ভেসে আসে। এভাবে আড্ডা দিয়েই গ্রামের তরুণ থেকে বয়সী ব্যক্তিদের সময় কাটে। দোকান থেকে মাত্র কয়েক পা ফেললেই মেঘনার ভাঙন চোখে পড়ে।

গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানালেন, গ্রামের এক হাজার বাড়ির মধ্যে মাত্র ৫টি বাড়ি অবশিষ্ট আছে। ১৪ সহস্রাধিক লোকের মধ্যে মাত্র শ পাঁচেক লোক এখনো বাপদাদার ভিটে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে। এ এলাকার বেশকিছু সম্পন্ন গৃহস্থ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।

এককালে ১২ একর জমির মালিক ওবায়দুল হক, ১৪ একর জমির মালিক মাহমুদুল হক, ১৫ একর জমির মালিক নূরুল ইসলাম, ১৬ একর জমির মালিক আবুল খায়ের তহশিলদার, ৮ একর জমির মালিক আবুল হোসেন, ২৫ একর জমির মালিক মোজাম্মেল হক পাটোয়ারীর মতো অনেক গৃহস্থ এখন আর এ এলাকায় নেই।

একই গ্রামের মো. সেলিম ৫৬ বছর বয়সে মেঘনার অনেক ভাঙাগড়া দেখেছেন। আগে কৃষি কাজ করলেও এখন হাতে কোনো কাজই নেই। তাইতো দোকানে বসেই কাটাচ্ছেন সময়। এককালে ৮০ শতাংশ জমির মালিক থাকলেও এখন কিছুই নেই। upokul

মেঘনা একেবারেই ঘর ছুঁই ছুঁই। যেকোনো সময় ধ্বসে যেতে পারে। একই এলাকার আবুল কাশেমের ঘরও মেঘনার গ্রাসের মুখোমুখি। ৭০ বছর বয়সী আহমদ উল্লাহ বলেন, মেঘনা তো সব নিয়া গেলো। কিছুই রক্ষা করতে পারলাম না। আমরা সাহায্য চাইনা। নদী ভাঙন রোধ চাই।

আলেকজান্ডারের আদালত পাড়ায় উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্যালয় ও গ্রামীণ ব্যাংক কার্যালয় হুমকির মুখে আছে। ভাঙনের কিনার থেকে ৮০০ গজ দূরে আছে রামগতি উপজেলা পরিষদ কার্যালয়।

এ এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোডেকের কার্যালয় অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে। পাটোয়ারী পাড়ায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র) মেঘনায় ডুবেছে। ৩১ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ভাঙনের দূরত্ব মাত্র ৫০ গজ। এভাবেই উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে।

নামে রামগতি উপজেলা হলেও উপজেলা পর্যায়ের সব অফিস রামগতি থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে আলেকজান্ডারে। রামগতির মূল ভূখন্ড ভাঙন কবলিত হওয়ায় অফিস-আদালত স্থানান্তর করা হয় এখানে।

কিন্তু এ এলাকাও এখন ভাঙনের তীরে মুখোমুখি। তবে ভাঙন আরও কাছে চলে এলে অফিস-আদালত কোথায় স্থানান্তর করা হবে এ বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি অফিস রক্ষায় কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

m3রামগতি ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার আবদুল কাদের জানান, ২০১১ সালের হিসাবে দেখা যায় উপজেলায় ১৫ হাজার ৮৯ দশমিক ৩৮ একর জমি মেঘনায় তলিয়ে গেছে। ফলে ৯ হাজার ৮৪২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

এর মধ্যে চর সেবেজ মৌজায় ৪৫৬ দশমিক ৪০ একরে ২২৩ পরিবার, আলেকজান্ডার মৌজায় ৫৭২ দশমিক ৯০ একরে ৯৮১ পরিবার, সবুজগ্রাম মৌজায় ৬২৯ দশমিক ৭৭ একরে ৩০৯ পরিবার, সেবাগ্রাম মৌজায় এক হাজার ৩২৮ দশমিক ৯৬ একরে ৮৬১ পরিবার, রূপালী মৌজায় ২ হাজার ৮০ দশমিক ৭৩ (পুরোটাই) একরে এক হাজার ৩৬২ পরিবার, চর আলগী মৌজায় ২৮৮ দশমিক ২৩ একরে ২৫৪ পরিবার, চর আবদুল্লাহ মৌজায় ৮ হাজার ৮ দশমিক ৩৮ (পুরোটাই) একরে ২ হাজার ৭১১ পরিবার এবং বড়খেড়ি মৌজায় এক হাজার ৭২৪ দশমিক এক একরে ২ হাজার ১৪১ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মেঘনা তীরের কমলনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙনের একই রূপ চোখে পড়ে। নদী ভাঙনের শিকার মানুষগুলোর দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই। বাড়ির ভিটে, গাছপালা ছাড়াও সহায় সম্পদ হারিয়ে মানুষগুলো পথে বসেছে। ভাঙন কবলিত মহব্বত নগরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বহু মানুষ নদী তীর থেকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন।

রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ স ম হাসান আল আমীন বাংলানিউজকে বলেন, আলেকজান্ডার পৌরসভাসহ ৬টি ইউনিয়ন ভাঙন কবলিত। এর মধ্যে চর আবদুল্লাহ ও চর আলেকজান্ডারের অবস্থা বেশি খারাপ। উপজেলা পরিষদ কার্যালয় থেকে মাত্র ৮০০ ফুট দূরে এখন ভাঙন। এ দূরত্ব ক্রমেই কমছে। রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ভাঙন প্রতিরোধে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে ভাঙন রোধ করা যাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।