পাইকগাছা, খুলনা থেকে: সুন্দরবন আর ঘের থেকে আসা জ্যান্ত কাঁকড়াগুলো ঝুড়িভর্তি হয়ে পৌঁছে যায় রাজধানীতে। এখান থেকে সরাসরি রপ্তানি হয় বিদেশে।
খুলনার পাইকগাছায় এমন দৃশ্য নিত্যদিনের। বিদেশের বাজারে অধিক চাহিদার এ কাঁকড়া সুন্দরবনসহ এলাকার বিভিন্ন ঘের থেকে ধরা হয়। বিদেশের বাজারে চাহিদা বাড়তে থাকায় এলাকায় কাঁকড়া ধরায় জীবিকা নির্বাহকারী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
পাইকগাছার কাঁকড়ার বাজারসহ পাইকগাছা ও কয়রার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল ঘুরে কাঁকড়া চাষি ও সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের মতে, এক সময় শুধু সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া আহরণ করা হতো। এখন অনেকেই কাঁকড়া ফ্যাটেনিং (পুষ্ট করা) জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ এলাকায় কাঁকড়া আহরণের পরিমাণও বাড়ছে।
কাঁকড়া আড়তের মালিকেরা বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমে ক্যাচাররা (যারা কাঁকড়া ধরে) ঘের নদী ও জঙ্গল থেকে ধরে আনা কাঁকড়া আড়তে নিয়ে আসে। মানসম্মত সাইজের কাঁকড়াগুলো সরাসরি আড়তের মাধ্যমে বাইরে যায়। আর অপুষ্ট কাঁকড়াগুলো ফ্যাটেনিং (পুষ্ট করা) পদ্ধতির মাধ্যমে ঘেরে কিংবা খাঁচায় বড় করে আবার আড়তে পাঠানো হয়। অপুষ্ট কাঁকড়া ফ্যাটেনিং করার জন্য অনেকে কম দামে এগুলো কিনে নেয়।
স্থানীয় বাজার সূত্র বলছে, পুরুষ কাঁকড়া ৫টি গ্রেডে এবং স্ত্রী কাঁকড়া তিনটি গ্রেডে ভাগ করে বেচাকেনা হয়। ৫০০ গ্রাম ওজনের পুরুষ কাঁকড়াগুলো ‘ডাবলএক্সএল’ গ্রেডের। স্থানীয় বাজারে এর প্রতি কেজির মূল্য ৫২০ টাকা।
এ ছাড়া ৪০০ গ্রাম ওজনের ‘এক্সএল’ গ্রেড প্রতি কেজি ৪২০ টাকা, ৩০০ গ্রাম ওজনের ‘এল’ গ্রেড প্রতি কেজি ৩২০ টাকা, ২০০ গ্রাম ওজনের ‘এসএম’ গ্রেড প্রতি কেজি ২২০ টাকা এবং ১৩০ গ্রাম ওজনের ‘এসএসএম’ গ্রেড প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হয়।
পুরুষ কাঁকড়ার চেয়ে স্ত্রী কাঁকড়ার মূল্য বেশি। ১৮০ গ্রাম ওজনের ‘এফ-ওয়ান’ গ্রেডভূক্ত স্ত্রী কাঁকড়ার প্রতি কেজি ৬০০ টাকা কেজি, ১৫০ গ্রাম ওজনের ‘এফ-টু’ গ্রেডের স্ত্রী কাঁকড়া ৩০০ টাকা কেজি এবং ১২০ গ্রাম ওজনের ‘এফ-থ্রি’ গ্রেডের স্ত্রী কাঁকড়া বিক্রি হয় ২০০ টাকা কেজি দরে।
পাইকগাছা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি অধিবাস সানা বাংলানিউজকে বলেন, আশির দশকে এ অঞ্চলের কাঁকড়া খুলনায় পাঠানো হতো। সেখান থেকে ঢাকায় যেতো। আর এখন কাঁকড়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এখান থেকে সরাসরি ঢাকা পাঠানো হয়। এখানকার বাজার থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ টন কাঁকড়া ঢাকার উত্তরায় রপ্তানিকারদের কাছে পাঠানো হয়।
পাইকগাছার লোনাপানি কেন্দ্র সূত্র বলছে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে রপ্তানিযোগ্য মৎস্য পণ্যের পরেই কাঁকড়ার স্থান। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন এ লোনাপানি কেন্দ্র থেকে পুকুরে কাঁকড়া ফ্যাটেনিং (পুষ্ট করা) বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়।
এরপর থেকেই গবেষণায় পাওয়া কলাকৌশল কৃষক এবং চাষি পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়। এরই মধ্যে এ অঞ্চল থেকে পাওয়া ‘শীলা’ জাতের কাঁকড়ার আন্তর্জাতিক বাজার প্রসারিত হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, খুলনা অঞ্চলে পাওয়া এ ‘শীলা’ জাতের কাঁকড়া সাধারণত ২ পিপিটি লোনাপানিতে সামুদ্রিক পরিবেশে বাস করতে পারে। কিন্তু ৭০ পিপিটির ওপরে এরা বাঁচতে পারে না।
বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, বরিশাল, সাতক্ষীরা, খুলনা, নোয়াখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ ও সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় এ জাতের কাঁকড়া আছে। তবে বেশি পাওয়া যায় খুলনা ও সুন্দরবন এলাকায়।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ১৮ থেকে ২০ মাস বয়সে কাঁকড়া ডিম দেয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস এদের প্রজননকাল। দু শ থেকে থেকে আড়াই শ গ্রাম ওজনের প্রতিটি স্ত্রী কাঁকড়া সাড়ে আট লাখ থেকে পনেরো লাখ ডিম দেয়।
আর ডিম থেকে কাঁকড়া হতে সময় নেয় ৩৫ থেকে ৪০ দিন। কাঁকড়ায় আমিষের পরিমাণ ১৯ থেকে ২৪ শতাংশ, স্নেহ জাতীয় পদার্থ ৬ শতাংশ, খনিজ পদার্থ ২ থেকে ৩ শতাংশ এবং পানি আছে ৭১ থেকে ৭৪ শতাংশ।
পাইকগাছা লোনাপানি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শ্যামলেন্দু বিকাশ সাহা বাংলানিউজকে বলেন, কাঁকড়া চাষ বলতে সাধারণত ছোট আকারের কাঁকড়াকে লোনাপানি অঞ্চলের ঘেরে মজুদকরণ, খাদ্য প্রয়োগ, রক্ষণাবেক্ষণ ও আহরণকে বোঝায়। লোনাপানির এলাকায় এ পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষের বিষয়ে আমরা চাষিদের সার্বিক সহায়তা দিয়ে থাকি।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/জিসিপি