দক্ষিণ বেদকাশী (কয়রা, খুলনা) ঘুরে এসে: বাঘের থাবায় মানুষের জীবন যাওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম ঘুরলে এ তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে।
সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম কয়রার মঠবাড়ি, কয়রা পাঁচ নম্বর, পাথরখালী, কাঠকাটা, গোলখালী, আংটিহারা, ঘড়িলাল, শ্যামনগরের নাপিতখালী, লেবুবুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার বহু মানুষ বাঘের থাবায় প্রাণ দিয়েছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যুতে এক একটি পরিবার পথে বসেছে। বহু নারী ‘বাঘ বিধবা’ হয়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়েছেন।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের গোলখালী গ্রামে শাকবাড়িয়া নদীর ধারে আফসার শেখের দোকানে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে বাঘের হিস্রতার নানা তথ্য মেলে। তারা জানান, কারও একখানা হাত কিংবা পা, আবার কারও মুখমণ্ডল উদ্ধার করা হয় বাঘের মুখ থেকে। আবার কারও কোনো সন্ধানই মেলে না। বাঘের আক্রমণের খবর পেয়ে এলাকার লোকজন ছুটে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। এই রেওয়াজ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। উদ্ধার করা যাক বা না যাক, খবর পেয়ে এলাকার একদল মানুষ ছুটে যাবেনই। তবে জীবিত উদ্ধারের সংখ্যা খুবই কম।
গোলখালী গ্রামের আ. হাকিম মোল্লা পাঁচ বছর আগে বাঘের পেটে গেছেন। দুই মেয়ে রাফেজা ও আফেজাকে নিয়ে ফজরের আজানের সময় বনের খালে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মেয়ে দু’টো তার কাছ থেকে একটু দূরে ছিল। এরই মধ্যে আকস্মিকভাবে বাঘের আক্রমণে পড়েন হাকিম। মেয়েরা বাড়ি ফিরে খবর জানালে এলাকা থেকে একদল লোক আ. হাকিমকে উদ্ধার করতে সেখানে যান। মুখমণ্ডল আর একখানা পা উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বাকিটা খেয়ে ফেলেছিল বাঘটি।
গোলখালীর ওয়াস কুরুনি নামের আরেকজন বাঘের পেটে গেছেন ২০০৯ সালের আইলার পরে। তিনিও ভোরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মাছ ধরার পাশাপাশি মধুও আহরণ করতেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন দুই ভাই আর জামাতা। গাছে উঠে মৌচাক কাটতে গেলে ওয়াস কুরুনিকে বাঘে ধরে। সঙ্গে থাকা অন্যরা ফিরে এলাকায় খবর জানান। লোকজন গিয়ে বাঘের মুখ থেকে মাত্র একটি হাত উদ্ধার করতে পেরেছেন।
আ. রশিদ মোল্লার বাবা আব্বাস মোল্লাকে বাঘে নিয়েছে দশ বছর আগে। বনে জোংরা নামের এক ধরনের শামুক সংগ্রহ করতেন। এ শামুক দিয়ে চুন তৈরি করা হয়। আব্বাস মোল্লাকে বাঘে নেওয়ার পর তার পরিবারে নেমে আসে চরম সংকট। কিশোর রশিদ মোল্লাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। তাকেও জীবিকার প্রয়োজনে ছুটতে হয় সুন্দরবনে। এখনও তিনি বনের কাজেই জীবিকা নির্বাহ করেন।
বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারানো মানুষের নাম লিখতে গেলে তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। এলাকাবাসী জানালেন, গোলখালীর আবুল বাসার গাজী, নজরুল ইসলাম ঢালী, আ. ছত্তার গাজী, আবদুল মজিদ শেখ, মাটিয়াভাঙার রাজ্জাক খান, শাহীনুর গাজী ও আতাহার আলী মোল্লা, কয়রা পাঁচ নম্বর এলাকার আবু তালেব, সোবাহান গাজী, নুরুদ্দিন, আজিজ গাজী ও আহম্মদ সানা, শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া গ্রামের আতিয়ার রহমানসহ বহু মানুষ বাঘের আক্রমণে জীবন দিয়েছেন।
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া গ্রামের রাবেয়া বেগম জানান, ছয় বছর আগে তার স্বামী আতিয়ার রহমানকে বাঘে নিয়েছে। বনে মাছ ধরার বরশি ফেলছিলেন তিনি। হঠাৎ বাঘের আক্রমণ। খবর পেয়ে এলাকাবাসী গিয়ে আতিয়ারের মাথাটা উদ্ধার করতে পেরেছেন। স্বামী হারানোর পর থেকে রাবেয়া বেগমের জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। তার দুই ছেলে এখন দিনমজুরি করে সংসার চালান।
পাঁচ নম্বর কয়রা এলাকার আবুল হোসেন গাজী বলেন, শুধু বাঘ নয়, বনের কুমির, সাপসহ সব বন্যপ্রাণীর সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। জীবন চালাতে হলে বনে যেতেই হবে। এলাকার অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ বননির্ভর জীবনযাপন করেন। বনে যেতে না পারলে সংসার চলে না। সব ধরনের বন্যপ্রাণীর আক্রমণের পরও এখানকার প্রজন্মের পর প্রজন্ম বন ঘিরেই বেঁচে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৩