ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

১২০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে বাঁশি নিয়ে ঘুরে বেড়ান লাবু মিয়া

এস এম এ কালাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৩
১২০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে বাঁশি নিয়ে ঘুরে বেড়ান লাবু মিয়া

ঢাকা: জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি, চাওয়া পাওয়ার হিসেবও তেমন একটা নেই। তবুও ১২০ বছরের বাঙালির ঐতিহ্য বাঁশির মধুর সুর হারিয়ে যাতে না যায় সেই লক্ষ্যে নতুন প্রজন্মকে বাঁশির সুরের সঙ্গে পরিচিত করতে এবং ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছি।

জানি না কতটুকু পারব। এই বয়সেও বাংলাদেশের কোথাও মেলার খবর পেলে বাঁশের বাঁশি নিয়ে ছুটে যাই। ব্যবসা নয় বাঙালির ঐতিহ্য এবং বাবার পেশাটাকে ধরে রাখতেই আমার এই চেষ্টা। জানি না এই চেষ্টা কতটুকু সফল হবে।

আগারগাঁওয়ে সরকারের উদ্যোগে চালু হয়েছে হলিডে মার্কেট। সেখানে স্টল নিয়েছিলেন বাঁশের বাঁশির কারিগর ও বংশীবাদক লাবু মিয়া। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নিজের এমন ইচ্ছে বাংলানিউজের কাছে এভাবেই তুলে ধরেন তিনি।

লাবু মিয়া বলেন, আমার বাঁশিতে হাতেখড়ি বাবার হাত ধরে। যখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকেই বাঁশির প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহই পেশায় পরিণত হয়েছে। এটা আমার বাবার ৬০ বছরের পেশা ছিল। বাবা ব্রিটিশ, ভারত, পূর্ব পাকিস্তানে বাঁশের বাঁশির ব্যবসা করেছেন। আমি স্বাধীন বাংলাদেশে এটা ধরে রেখেছি। বাবার পর আমিও ৬০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। আমার কাছে এটা আমার বাবার এবং বাঙালির ঐতিহ্য। সেই থেকে এখন পর্যন্ত চেষ্টা করে যাচ্ছি এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে। বাবার ঐতিহ্যকে আমি এখনো লালন করে আছি। আমার স্বপ্ন বংশ পরম্পরায় এই ঐতিহ্যের পেশাকে ধরে রাখা।

তিনি বলেন, আমার সন্তানরা উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে, তারা বাবার পেশায় আসবে কিনা জানি না। তবে আমার হাত থেকে গড়ে উঠেছে অনেক ছাত্র এরা হয়তো ঐতিহ্যটাকে ধরে রাখবে।

আধুনিক সঙ্গীত সরঞ্জামের ভিড়ে বিলুপ্তপ্রায় বাঁশি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে তরুণ প্রজন্মকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই বংশীবাদক বলেন, এক সময় বাঁশি রাখালরা বাজাতো, কিন্তু বাঁশি উচ্চাঙ্গ সংগীতের একটি অংশ। বাঁশি বাজানোর জন্য পড়াশোনার প্রয়োজন আছে, বাঁশি বাজানো একটি মেরিটেশন, এটা এখন শিক্ষিত সমাজে চলে এসেছে। এখন এটাকে অনেকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, যারা পেশা হিসেবে নিয়েছেন তারা ভালো করছেন। আমার কয়েকজন ছাত্র এটাকে পেশা হিসেবে নিয়ে মাসে প্রায় লাখ টাকা আয় করছে। বর্তমানে আমি এটাকে পেশা হিসেবে নিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তুলে ধরছি, এই চেষ্টা চালিয়ে যাব, কতটা পারব জানি না।

নিজের বানানো বাঁশি সম্পর্কে তিনি বলেন, গ্রাম থেকে শহর বাঁশি নিয়ে ঘুরে বেড়াই মনের টানে, আমার বানানো বাঁশির কদর দেশ-বিদেশে রয়েছে। নিজ দেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বাঁশি রপ্তানিকারকরা আমার কাছ থেকে বাঁশি নিয়ে যান। এছাড়া নিজের পেশা ধরে রাখতে রাজধানীর আল্পনা প্লাজায় ‘লাবু ফ্লুট’ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি।

৬০ বছরের পেশায় লাবু মিয়ার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একশরও বেশি বাঁশি সংগ্রহে রয়েছে। বাঁশি সংগ্রহ করাটাও তার নেশা হয়ে গেছে। আড় বাঁশি, হুইসেল বাঁশি, বাঁশের বাঁশিসহ অনেক ধরনের বাঁশি তার সংগ্রহে রয়েছে।

হলিডে মার্কেট নিয়ে তিনি বলেন, সরকারের এই উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়, মানুষ আসছে, জানছে এবং কিনছে। তবে মার্কেটের প্রচারণা একটু বাড়ানো উচিত। আর ভাড়াটাও একটু সমন্বয় করা দরকার। লোক আসছে, ভিড় করছে আমার সুর শুনতে সময় দিচ্ছে তাই আগামীতেও এই মার্কেটে তিনি নিয়মিত আসবেন বলেও উল্লেখ করেন।

নিজের হাতে তৈরি বাঁশি ও সঙ্গীতের অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করা লাবু মিয়ার ব্যবসা হলেও শেষ বয়সে তিনি দেশজুড়ে উপার্জন নয়, সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। তরুণদের আকৃষ্ট করতে কৌশল হিসেবে বিভিন্ন সুরে বাঁশি বাজান। তার সুর শুনে অনেকেই বাঁশি কেনেন এবং শেখার আগ্রহ দেখান; কেউ কেউ হয়তো আসেনও। এভাবেই ৫০ জনেরও বেশি মানুষ তার কাছ থেকে বাঁশি বাজানো শিখেছেন। এখানেই নিজের স্বার্থকতা বলে তিনি জানান।  

বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৩
এসএমএকে/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।