ঢাকা, সোমবার, ৭ আশ্বিন ১৪৩২, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার

ইরানের কারাগারে যেভাবে বদলে যায় বন্দিদের জীবন

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:০৮, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫
ইরানের কারাগারে যেভাবে বদলে যায় বন্দিদের জীবন কারামুক্তির পর স্বজনের সঙ্গে আলিঙ্গন করছেন এক বন্দি

তেহরানের এক কারাগারে হঠাৎই শোনা গেল আনন্দধ্বনি। বন্দিরা টেলিভিশনের সামনে লাফিয়ে উঠছেন, কেউ চোখ মুছছেন, কেউ আবার পরিবারকে ফোনে জানাচ্ছেন সুখবর।

ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনি প্রায় ৭০ হাজার বন্দিকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। কারাগারের অন্ধকার করিডোরগুলোতে যেন এক অদৃশ্য আলোর ঝলকানি বয়ে গেল।

ইরানে কারাগার কেবল শাস্তির স্থান নয়, বরং বন্দিদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। ইসলামি শিক্ষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই বিচারব্যবস্থায় বন্দিদের মানবিক মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি সমাজে পুনঃএকীভূত হওয়ার সুযোগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এক মাদকসেবীর মুক্তির গল্প

মাহমুদকে ২০২৩ সালে মাদকসহ গ্রেপ্তারের পর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ইরানে তার অপরাধকে ‘ক্ষুদ্র পরিসরের মাদকদ্রব্য রাখা’ হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ তিনি নিজেই মাদক সেবন করতেন এবং বড় এক পরিবেশকের কাছ থেকে সংগ্রহের পর অল্প কিছু পরিচিতজনের কাছে তা বিক্রি করতেন।

তেহরানের এক কারাগারে দুই বছর কাটানোর পর ৩২ বছর বয়সী মাহমুদ এখন পুরোপুরি মাদকমুক্ত জীবনযাপন করছেন। তিনি নিয়মিতভাবে কারাগারে আয়োজিত ‘এনএ’ (নারকোটিকস অ্যানোনিমাস) সেশনে অংশ নিয়েছেন এবং কারাগারের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন দক্ষতা অর্জন করেছেন। কিছুদিন আগে তিনি সহবন্দিদের বলেছিলেন, ২০২৮ সালে মুক্তির পর তিনি একজন ওয়েল্ডার হিসেবে কাজ শুরু করতে চান।

কারাবন্দি অবস্থায় মাহমুদ নিয়মিতভাবে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। যখন তিনি জানতে পারলেন যে, আয়াতুল্লাহ খামেনি তাকে ক্ষমা করেছেন এবং আর বাকি সাজা ভোগ করতে হবে না, তখন মাকেই প্রথম কল করেন।

মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর মাহমুদ এক সাংবাদিককে বলেছেন, “আমি নিজের চেয়ে আম্মুর জন্যই বেশি খুশি। আমার জন্য তিনি অনেক চিন্তিত ছিলেন। এখন যেহেতু আমি মাদকমুক্ত, জীবিকা অর্জনের জন্য একটি দক্ষতা অর্জন করেছি এবং শিগগিরই জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছি, সে কারণে আমার মা সবচেয়ে বেশি খুশি। ”

গণক্ষমার দর্শন ও প্রক্রিয়া

বিচার বিভাগের প্রধান বন্দিদের ক্ষমার একটি  মানদণ্ড প্রণয়ন করে তার তালিকা সর্বোচ্চ নেতার কাছে উপস্থাপন করেন। দয়ার নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মদিন বা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়াতুল্লাহ খামেনি তা অনুমোদন করেন। সর্বোচ্চ নেতার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা অনুমোদনের পর তা দেশের বিচারিক কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। ক্ষমা ঘোষণার পর ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বন্দিদের আনন্দঘন মুহূর্ত প্রচার করেছে। কোথাও বন্দিরা খুশিতে চিৎকার করছেন, কোথাও পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন প্রিয়জনের মুক্তির খবর পেয়ে।


কারাবন্দিদের সেলাই কাজ শেখানো হয়

ক্ষমার ধরন ও মানদণ্ড
ইরানে কারাবন্দিদের জন্য দুই ধরনের ক্ষমা প্রচলিত। ১. মামলাভিত্তিক ক্ষমা ২. মানদণ্ডভিত্তিক ক্ষমা।

মামলাভিত্তিক ক্ষমা: অপরাধী যদি অনিচ্ছাকৃত অপরাধ বা ছোটখাটো অপরাধে দণ্ডিত হন, কারাগারে ভালো আচরণ করেন এবং পুনরায় অপরাধ না করার সম্ভাবনা থাকে, তবে মুক্তি বা সাজা হ্রাসের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় পরিবারপ্রধান নারী, বৃদ্ধ ও মারণব্যাধিতে আক্রান্ত বন্দিদের। তবে এটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। আবেদন শুরু হয় পরিবার, আইনজীবী বা কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এবং ধাপে ধাপে আদালত পেরিয়ে সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদন পর্যন্ত পৌঁছায়।

মানদণ্ডভিত্তিক ক্ষমা: পৃথক মামলা পর্যালোচনা করা হয় না। বিচার বিভাগের প্রধান নির্দিষ্ট মানদণ্ড তৈরি করেন এবং কেবল সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদন পেলেই তা কার্যকর হয়।

উভয় প্রকারের ক্ষমার চূড়ান্ত কর্তৃত্ব সর্বোচ্চ নেতার রয়েছে, যা ইরানি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১০, দফা ১১-এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বিচার বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশের ভিত্তিতে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।

ইরান এ পর্যন্ত তিনবার মানদণ্ডভিত্তিক ক্ষমা প্রয়োগ করেছে। এবার ৭০,০০০ বন্দি সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন। এর আগে ২০২২ সালে প্রায় এক লাখ বন্দি মুক্তি বা সাজা হ্রাসের জন্য যোগ্য হয়েছিল। ২০১৮ সালে ৬০,০০০ থেকে ৭০,০০০ কয়েদী ক্ষমার যোগ্য হয়েছিলেন।

পশ্চিমা অভিযোগ ও বাস্তবতা

পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যেই ইরানের কারাগারগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু ইরানে কারাবন্দিদের সংশোধন, পুনর্বাসন ও ক্ষমা প্রথা-ওইসব অভিযোগের অসারতাই প্রমাণ করে। ইরানের ফৌজদারি আইন ইসলামি শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যেখানে বলা হয়েছে বন্দিদেরও অন্য মানুষের মতো অধিকার রয়েছে। যে অপরাধই করুক না কেন, তাদের মর্যাদা ও মানবিকতা সংরক্ষণ করতে হবে।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ড. হেসামউদ্দিন বোরুমান্দ এ সম্পর্কে বলেন, “পশ্চিমা দেশগুলো গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যাকে সমর্থন করছে, অথচ একই সময়ে তারা ইরানের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে এবং ইসলামকে বিতর্কিত করে। ”

কারাগারে সংশোধন কার্যক্রম

ইরানি কারাগারগুলো শাস্তির পাশাপাশি বন্দিদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করে। এই নিবন্ধে কিছু পুনর্বাসন কার্যক্রম তুলে ধরা হলো:

শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন: কাঠমিস্ত্রি, ওয়েল্ডিং, সেলাই, কৃষিকাজ, কম্পিউটার ব্যবহারের মতো কোর্স রয়েছে। অনেক বন্দি মুক্তির পর এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

নেশা নিরাময় ও মানসিক সহায়তা: নিয়মিত এনএ সভা, কাউন্সেলিং সেশন ও মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা দেওয়া হয়।

ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা: কুরআন শিক্ষা, নৈতিকতা বিষয়ক ক্লাস এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্দিদের মানসিক শক্তি যোগায়।

পরিবার-সংযোগ: নিয়মিত ফোনকল, সাক্ষাৎ ও শিশুদের জন্য বিশেষ ভিজিটিং রুম বন্দিদের মানসিক স্থিতি বজায় রাখে।

পুনর্বাসন প্রকল্প: বন্দিদের তৈরি হস্তশিল্প ও কারুকাজ বিক্রি করা হয়, আয় পরিবার ও মুক্তির পর কাজে লাগে।

ফার্স প্রদেশের মডেল উদ্যোগ

ইরানের ফার্স প্রদেশের কারাগার ও সংশোধনাগারগুলোতে বন্দিদের জন্য ৭০টিরও বেশি সংশোধন ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রদেশের কারা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ইসহাক ইব্রাহিমি।


কারাগারে কুরআন শিক্ষা ক্লাস

ইলনা সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বন্দিদের অবসর সময়কে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং তাদেরকে সুস্থ ও অভ্যাসগতভাবে সমাজে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় সাংস্কৃতিক, শিল্পকলা, ধর্মীয় শিক্ষা ও আকিদা, কুরআন শিক্ষা, সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, নৈতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রম, জীবনদক্ষতা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দক্ষ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এসব কর্মসূচির লক্ষ্য হলো— সকল বন্দি, হোক সে আটক কিংবা দণ্ডপ্রাপ্ত, তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা। কারণ অপরাধমূলক চিন্তা ও আচরণ সংশোধনের মাধ্যমেই বন্দিদের সুস্থভাবে সমাজে ফেরানো সম্ভব।

ইব্রাহিমি আরও জানান, বন্দিদের এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ও ইতিবাচক আচরণ পরিবর্তনের ভিত্তিতে বিচার বিভাগীয় কমিশন ও প্রাদেশিক ক্ষমা কমিশন থেকে বিভিন্ন আইনি সুবিধা ও ছাড় দেওয়া হয়। এতে বন্দিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে নানা ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

তিনি উল্লেখ করেন, মুক্তির পর আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ার হার কমে যাওয়াই এ উদ্যোগের অন্যতম বড় অর্জন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যারা মুক্তির আগে ও পরে কারা অধিদপ্তরের সামাজিক ও সহায়ক সেবার আওতায় থেকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরামর্শ এবং স্ব-উদ্যোগে কর্মসংস্থানের সুবিধা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আবার কারাগারে ফেরার হার দুই শতাংশেরও কম। এ কারণে তিনি অর্থনৈতিক ও শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও সমিতিগুলোকে মুক্ত বন্দিদের কর্মসংস্থানে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

কুরআন শিক্ষামূলক কর্মসূচির প্রসঙ্গ টেনে ইব্রাহিমি জানান, বন্দিদের প্রায় ৭৫ শতাংশই কুরআন তিলাওয়াত, হিফজ, অর্থবোধ ও তাফসিরে অংশ নিয়েছেন। শিরাজ কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় ২,৫০০ বন্দি আংশিক বা পূর্ণ হাফেজ হয়েছেন। এতে বন্দিরা শুধু আইনি সুবিধাই পাননি, বরং তাদের নৈতিক ও আচরণগত উন্নতিও ঘটেছে, যা সামগ্রিকভাবে কারাগারের পরিবেশকে সুস্থ করেছে।

শেষে ইব্রাহিমি জোর দিয়ে বলেন, কারা অধিদপ্তরের মূল নীতি হলো বন্দিদের ব্যক্তিত্ব পুনর্গঠন এবং তাদেরকে সুস্থ সমাজজীবনের জন্য প্রস্তুত করা। বর্তমানে যে কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোই এই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের মূলভিত্তি।

মানবিক দর্শন

ইরানের কারাগার ব্যবস্থা কেবল শাস্তির প্রাচীরেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা অতিক্রম করে গড়ে তোলে পুনর্বাসনের সেতু—যেখানে মানবিকতাই হয়ে ওঠে প্রধান হাতিয়ার। এই নীতি প্রমাণ করে যে, শাস্তি নয়, সংশোধন ও পুনরায় সমাজে ফিরিয়ে আনাই হলো একটি দায়িত্বশীল বিচারব্যবস্থার প্রকৃত লক্ষ্য। গণক্ষমার কারণে মাহমুদের মতো হাজারো মানুষ এখানে খুঁজে পায় জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার সাহস, শেখে নতুন দক্ষতা, ফিরে পায় নিজের প্রতি শ্রদ্ধা।

এই গণক্ষমা কেবল আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি সামাজিক দর্শনের প্রকাশ—যেখানে ইসলামি শিক্ষার আলোকে গড়ে ওঠে সহমর্মিতা, ক্ষমা ও পুনর্বাসনের সংস্কৃতি। এটি ইরানের সমাজকে শুধু অপরাধমুক্তই করে না, বরং গভীর মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধও করে তোলে।

পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনার মুখেও ইরান এই নীতির মাধ্যমে দেখিয়ে দেয় যে, একটি রাষ্ট্র চাইলে তার নীতির কেন্দ্রে রাখতে পারে মানবিকতাকে। আর এর সুফল কেবল কোনো একক ব্যক্তি ভোগ করে না, বরং গোটা সমাজই পায় এক নিরাপদ ও সুস্থ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।