জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি): পার্বত্য রাঙামাটি থেকে সংগৃহীত বিশাল আকারের মাশরুমের কৃত্রিম উৎপাদনে সফল হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
বিশাল আকৃতির এই মাশরুমটি Tricholomataceae পরিবারভুক্ত এ দেশের তথা এশিয়ার সবচেয়ে বৃহদাকার মাশরুম।
মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল খায়েরের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণার পাশাপাশি বাংলাদেশ জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কেন্দ্রে মাশরুম গবেষক হিসেবেও কর্মরত আছেন।
বৃহদাকার এই মাশরুম সম্পর্কে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার গবেষণার বিষয় আমাদের রাঙামাটির পার্বত্য অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বিভিন্ন রকম মাশরুমের শনাক্তকরণ এবং জীববিজ্ঞান বিষয়ে হলেও মাশরুমের প্রতি বিশেষ অনুরাগ থাকাতে সম্ভাবনাময় এই মাশরুমকে কৃত্রিম আবাদের জন্য বেছে নিই।
তিনি বলেন, এক বছর ছয় মাস ধরে চেষ্টার পর ইথ্নো অ্যাগ্রো সার্ভিসেস মাশরুম ফার্মের অতি সাধারণ নীল পলিথিন নির্মিত গ্রীন হাউজে এই মাশরুম ফলাতে সক্ষম হই।
তিনি বলেন, আমি ২০১২ সালের জুলাইর শেষের দিকে রাঙামাটি শহর থেকে জলপথে অনেকটা দূরে বালুখালি জায়গা থেকে এই মাশরুমটি সংগ্রহ করি। আমাদের পাহাড়ি আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী বন থেকে খাবার সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন। এর মধ্যে মাশরুম তাদের অন্যতম। মাশরুমকে তারা ‘দেবতাদের পাঠানো খাদ্য’ বলে বিশ্বাস করেন।
তিনি বলেন, অন্যতম প্রিয় খাবার প্রাকৃতিক মাশরুম গ্রহণের জন্য তাদের রয়েছে পর্যাপ্ত বংশানুক্রমিক জ্ঞান। তাদের বংশানুক্রমিক জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারেন, কোন মাশরুমটি খাওয়া যাবে এবং কোনগুলো খাওয়া যাবে না। আমাদের পাহাড়ি আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী মাশরুমকে ওল এবং খাবার অযোগ্য মাশরুমকে বিষওল বলেন।
গবেষক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ২০১০ সালের জুলাই মাসে রাঙামাটির বালুখালি অঞ্চলে আদিবাসীদের বসতবাড়ির পাশে একসঙ্গে গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠে এই মাশরুম। এত বড় দৈত্যাকার মাশরুম তারা এ জীবনে আর দেখেননি।
গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানসহ সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন এই মাশরুম তারা খাবেন না। কেননা, এটি দেবতাদের পাঠানো কোনো বিশেষ উপহার যা নিছক উদরপুর্তিতে ব্যবহার করা যাবে না। তারা সবাই মিলে সেই অতি দৈত্যাকার মাশরুমকে সমাধিস্থ করে সমাধির পরিসীমা বরাবর বসে চোখের জলে দেবতার প্রশস্তি পাঠ করেন। ফলে ওই সময় কোনো মাশরুম সংগ্রহ করা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, একসঙ্গে গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা মাশরুমের পরিমাণ পঞ্চাশ কেজির মতো।
মাশরুমটির আঞ্চলিক নাম খুব মজার। দেবতাদের পাঠানো বলে পাহাড়ি জনপদের আদিবাসীরা এটিকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘দেবেদা ওল অর্থাৎ ‘’দেবতার মাশরুম’ বলে জানেন। অনেক শিক্ষিত পাহাড়ি আদিবাসী ও বাঙালি বিশাল আকৃতির জন্য মাশরুমটিকে ‘দৈত্যাকার মাশরুম হিসেবেও জানেন।
মাশরুমটির গঠন সম্পর্কে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, দৈত্যাকার মাশরুমের পাইলিয়াস (ছাতা) প্রাইমর্ডিয়া বা কুঁড়ি অবস্থায় সাদা, পরে ক্রমশ ধূসর-সাদা রং ধারণ করে। পরিণত অবস্থায় যার ব্যাস ৩০-৩৫ সে.মি. যা প্রথমে উত্তলাকার পরে প্রায় সমান্তরাল, মসৃণ ত্বকযুক্ত, কিনারা অবিভক্ত এবং বাঁকানো।
গিল ধূসর-সাদা, খাঁজযুক্ত এবং বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের এবং জড়াজড়ি করে অবস্থিত। স্টাইপ বা ছাতার দণ্ডকেন্দ্র বরাবর অবস্থিত, ১৫-২০ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা এবং প্রস্থে ৪-৮ সে.মি. সাদা, মসৃণ ত্বকযুক্ত।
মাশরুমটি খাবারযোগ্য এবং এতে রয়েছে আমাদের দেহ গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন অজৈব খনিজ পদার্থ এবং অকাল বার্ধক্য ঠেকানোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান।
প্রতিবেশী চাইনিজরা এটি দিয়ে স্যুপ এবং ফ্রাইড রাইস তৈরি করে খান। উৎপাদিত মাশরুমের পরিমাণ অল্প হলেও এটির অঙ্গসংস্থানিক গঠন প্রাকৃতিক মাশরুমের মত হুবহু পাওয়া গেছে। অর্থাৎ উৎপাদনের জন্য এর জেনেটিক ক্ষমতা রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এটি হয়ত মাটিতে প্রোথিত কেটে ফেলা পুরনো কোনো গাছের পুরো শেকড় থেকে পুষ্টি নিয়ে বেড়ে ওঠে।
আমরা যদি এটিকে উপযুক্ত চাষের উপাদান সরবরাহ করতে পারি, তবে এটি আমাদের ভালো বিনিময় প্রদান করবে। শিগগিরই বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য অত্যন্ত মানানসই জাত হিসেবে এটি আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
মাশরুম চাষীদের প্রয়োজনে এই মাশরুম নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
মাশরুমটি সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল খায়ের বলেন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ এই মাশরুমটি খান। জরিপ করতে গিয়ে প্রকৃতি থেকে এই মাশরুমটি পাওয়া যায়। পরে সে এটি কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। এই মাশরুমটি ভক্ষণযোগ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৪