কক্সবাজার থেকে ফিরে: বাংলার প্রকৃতিতে এখন চলছে ঋতুর পালাবদল। এরই মধ্যে অভিষেক ঘটেছে ঋতুরানী হেমন্তের।
আর দিন যতই গড়াচ্ছে তাপমাত্রার পারদ ততই নামছে নিচে। ঘন কুয়াশায় এখনই উনুনের ধোঁয়ার মত দেখাচ্ছে ভোরের স্নিগ্ধ আলো। সকালে মিষ্টি রোদ হাসলেই কেবল আড়মোড়া ভাঙছে দীর্ঘ রজনীর। প্রকৃতিতে যেন সূচিত হয়েছে শীত ও গরমের অসাধারণ এক মিতালি।
আর ছন্দময় এমন আবহাওয়ায় বেড়াতে কার না ভালো লাগে! তাইতো শুরু হয়ে গেছে পর্যটন মৌসুম। প্রকৃতিতে যখন হেমন্তের পরশ ঠিক তখন থেমে নেই ভ্রমণ পিপাসুরাও।
সাগরের নোনা জলের স্পর্শ পেতে এখনই ছুটছেন সমুদ্র কন্যা কক্সবাজারে। কী? সমুদ্র সৈকতের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই উত্তাল সৈকতের ছবি তাইতো? সুখস্মৃতি তো চোখের সামনে ভেসে উঠবেই। কারণ এমন মায়াবী সৌন্দর্য আর কোথায় মিলবে। সাগরগর্ভে সূর্যাস্ত, উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে রঙিন সাম্পানের নাচন, সমুদ্রতটে আছড়ে পড়া স্রোত, নোনাপানির সঙ্গে শুভ্র সফেদ ফেনা; এসব আর কোথায় মিলবে?
তাইতো ১২০ কিলোমিটারের দীর্ঘতম এ সৈকত এজন্যই সবার কাছে সব সময়ই আনন্দ ও বিনোদনের সেরা ঠিকানা। এ সমুদ্র সমাদৃত পুরো পৃথিবীতেই। মৌসুমের শুরুতেই তাই পর্যটকদের কোলাহল বেড়েছে সুবিশাল এ সৈকতে।
তবে দেশের উত্তরে শীতের হাতছানি মিললেও দক্ষিণের শহর কক্সবাজারের আবহাওয়া কিন্তু এখনও উষ্ণ। এরপরও থেমে নেই প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। তাদের পদচারণায় এখনই মুখরিত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর দীর্ঘতম অখন্ডিত এ সমুদ্র সৈকত। বালুকাময় সমুদ্র সৈকতে কাদার কোনো অস্তিত্ব না থাকায় পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের আনন্দ এখানে বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
যদিও বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের তোড়ে কক্সবাজার সৈকতের অনেক জায়গায় ভাঙন এখনও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে সমুদ্র সৈকতে সূর্যদোয় থেকে সূর্যাস্ত আর গোধূলি লগ্ন থেকে পূর্ণিমা রাত; সব সময়ই থাকছে জমজমাট। সমুদ্রতটের বালুকাবেলায় বসে সমুদ্রবিলাসের কথা ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠছে পর্যটকদের মনপ্রাণ। এর ওপর নজর কাড়ছে সৈকত সংলগ্ন শামুক-ঝিনুকসহ নানা প্রজাতির প্রবাল সমৃদ্ধ বিপণি বিতান, অত্যাধুনিক হোটেল-মোটেল-কটেজ৷ আরও রয়েছে নিত্যসাজে সজ্জিত বার্মিজ মার্কেটসমূহ। বাংলা কার্তিক মাস থেকেই শুরু হয়ে যায় পর্যটন মৌসুম। তাই বছর ঘুরে পর্যটকদের বিচরণে আবারও প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে মায়াবী প্রকৃতির অনুপম নিসর্গ এ ছোট্ট শহর কক্সবাজার। প্রতিদিন ক্ষণে ক্ষণে যেন রঙ ও রূপ পাল্টায় এ সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
যদিও শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বা বসন্ত নেই, সব সময়ই এমন সৌন্দর্য বিলিয়ে দেয় সুবিশাল এ সমুদ্র সৈকত। তাই প্রতিদিন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক এ সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছেন। আর কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে কেবল সমুদ্র সৈকতই নয়, ঘুরে দেখছেন সেখানকার আশেপাশের আরও কিছু দর্শনীয় স্থান। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে- হিমছড়ি, ইনানী সমুদ্র সৈকত, মহেশখালী, রামু বৌদ্ধ বিহার, রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড এবং সেন্টমার্টিন।
কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডা এলাকার ফায়সাল আহমেদ ও তার সহধর্মিণী। জানালেন, সকাল থেকেই এখানে আছেন। দু’জনেই সুমদ্র ও সৈকতের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করছেন। এ যুগলের ভাষ্যনুযায়ী সৈকতের কোনো সময় নেই। সব সময়ই এখানে পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। কেউ সূর্যোদয়ের সময় আসেন, কেউ সূর্যাস্ত দেখতে আসেন। আবার কেউ সকালে আসেন সমুদ্র স্নানের জন্য। কেউ রাতে সৈকতে বসে একাকিত্ব মনে আকাশের তারায় আবিষ্ট হয়ে থাকেন।
সমুদ্র সৈকতে কথা হয় সিলেটের জাফলং থেকে আসা সিফাত, আরাফাত, রাসেলও সাফিনের সঙ্গে। তারা জানান, বন্ধুরা মিলে সিলেট থেকে বেড়াতে এসেছেন সমুদ্রে। আরও একঝাঁক বন্ধু আসছেন। তারা পথে রয়েছেন। সবাই মিলে পরিকল্পনা করেছেন কক্সবাজারে শুধু রাতের সৌন্দর্যই উপভোগ করবেন। এরপরও অন্যরা আসতে দেরি হওয়ায় তারা একটু আগেই এসেছেন। সমুদ্রস্নানের পাশপাশি আপাতত এ চার বন্ধু ওয়াটার বাইক নিয়ে সমু্দ্রে দাপিয়ে বেড়াবেন। এরপর সবাই আসলে রাতের খাবার শেষে আবারও সুগন্ধা সৈকতে নেমে পড়বেন বলে জানান। রাতের সমুদ্র দেখতে দেখতে নিজেদের হারিয়ে দেবেন অন্য জগতে। পুরো রাতটাই সমুদ্রের বালিয়াড়িতে কাটিয়ে দেবেন বলেও জানান।
তবে কেবল এ তরুণরাই নয়- এমনভাবে আপন মনে এখন সমুদ্র বিলাসে মেতেছেন শিশু, কিশোর, যুবক-যুবতীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
স্থানীয়রা বলছেন- এখনও স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়নি। পরীক্ষা শেষে পুরোদমে জমে উঠবে এ সমুদ্র শহর। তখন ঠাঁই মিলবে না হোটেল-মোটেলেও।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, এ জেলা পর্যটকবান্ধব করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। আর কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। এটি পাহাড়, নদী ও সমুদ্র বেষ্টিত একটি শহর। এটি এমন একটি জেলা- যেখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নির্মিত মোটেল উপল, প্রবাল এবং লাবণী ছাড়াও আত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সমন্বিত আবাসিক হোটেলও রয়েছে।
এছাড়া এখানে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে ঝিনুক মার্কেট। সীমান্তপথে মিয়ানমার থাইল্যান্ড, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে আসা বাহারি জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে বার্মিজ মার্কেট। যা পর্যটকদের সহজেই আকর্ষণ করে। এখানে বিভিন্ন উপজাতি বা নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাস করে যা শহরটিকে আরও বৈচিত্র্যময় করেছে।
এছাড়া পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২২
এসএস/জেডএ