বেঁচে থাকা মোটেই যা তা ব্যাপার নয়--
তোমাকে বাঁচতে হবে দারুণ নিষ্ঠায়।
(তুর্কি কবি নাজিম হিকমত : অনুবাদ আজফার হোসেন)
মিঠু সকাল থেকেই উশখুশ করছে বাইরে যাওয়ার জন্য কিন্তু মায়ের জন্য পারছে না, সানজিদা ছেলের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে কড়াকড়ি আদেশ জারি করেছে, মিলিটারি আইন একে অমান্য করা যাবে না ।
সানজিদা বড় আপার বাসা থেকে আসার পর থেকে খালি হাত পরিষ্কার করতেছে, গরম পানি , স্যাভলন দিয়ে গোসল করতেছে, তবু মনে একটা খুঁতখুঁতানি, বার বার হ্যান্ড -ওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার পরও মনে হচ্ছে হাতে কিছু লেগে আছে, যে তোয়ালে ব্যবহার করছে সেটাকে আবার ধোয়া। ছুটা বুয়াকে ঘরে ঢোকার পর বাথরুমে ঢুকিয়ে গোসল করিয়ে কাজ শুরু করানো, তবু কেমন যেন একটা আতঙ্ক, মনে হচ্ছে হাতে কিছু একটা লেগে আছে বার বার হাত ধুতে ধুতে চামড়ার অবস্থা খারাপ বানিয়ে ফেলেছে সানজিদা ।
মিঠু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মার্ কাছে এসে বললো, মা আমাদের একটা গ্রুপ প্রেসেন্টেশন আছে, কোর্সমেটরা মিলে করতে হবে, আসিফের বাসায় সবাই আসবে আজ, এটা করতেই হবে, না হলে নেক্সট সেমিস্টারে প্রব্লেম হবে।
নো নেভার, আই ডোন্ট এলাউ ইউ গো আউটসাইড ইন দিস সিচুয়েশন।
কেন বাবা বাইরে যাচ্ছে না ? অফিস যাচ্ছে না ? তার যাওয়াতো বন্ধ করা হচ্ছে না, সে বাসায় করোনা আনতে পারে না ?
তোমার বাবাকেতো যেতে হবে, সরকারি অফিস, না গেলে চাকরি থাকবে না, সরকারি অফিস না চললে সব কিছু ভেঙে পড়বে ।
বাবা যদি বাসায় করোনা নিয়ে আসে তাহলেতো আমরা সবাই আক্রান্ত হবো ।
বাবা মাস্ক, গ্লাভস পরে যাচ্ছে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করছে, কিছু হবে না ইনশাল্লাহ.। .
আমিও মাস্ক পরে বাইরে যাবো, আমার মাস্ক পড়া হলো না, শুধু ফেসবুকে একটা ছবি পোস্ট করা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে নাই, প্লিজ মা আজ বাইরে যাবো আর যাবো না ।
না মিঠু তুমি বুঝতে পারছো না, এই অবস্থায় তোমার বাইরে যাওয়াটা ঠিক হবে না, তুমিতো একটু আসি বলে পাঁচ -ছয় ঘন্টা কাটিয়ে দেবে, তোমার কোনো ট্রেস পাওয়া যাবে না । সবাই কোয়ারেন্টাইনে আছে আর তুমি বন্ধুদের নিয়ে নাচানাচি না করে কয়েকদিন থাকতে পারবে না ? জানো যুদ্ধের সময় আমরা কত কষ্ট করে কেরানীগঞ্জে এক পীরের আঁখড়ায় লুকিয়ে ছিলাম, ঘর থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ ছিল, সারাদিন বোরকা পরে থাকতে হতো, মোটা চাল এর ভাত আর শাক দিয়ে খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছি ।
তোমার এতকিছু মনে আছে, তুমিতো অনেক ছোট ছিলা।
মনে নাই সবকিছু তোমার নানুর কাছে শুনেছি, মনে করো এখন একটা যুদ্ধের অবস্থায় আছো ।
মিঠু মুখ গোমড়া করে কম্পিউটার রিস্টার্ট দিয়ে ফুল ভলিউমে আফ্রিকান বাঁশি শুনতে লাগলো, গত কয়েকদিন ধরেই নাতাশার সাথে দেখা হচ্ছে না, ওর সাথে এতো দীর্ঘ বিরতি কখনো হয় নি, নাতাশা একটু ভীতু প্রকৃতির , সারাক্ষন কে দেখলো, কে দেখলো, এই ভয়ে থাকে । মিঠু ওকে বলেছে কেউ দেখলে বা পরে জানতে চাইলে বলবে ক্লাসমেট, ব্যাস, এই নিয়ে এতো লুকোছাপার কি, নাতাশার সাথে মিঠুর গত এক বছর ধরে যোগাযোগ, নর্থ -সাউথ থেকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে পরিচয়, প্রথম দিন থেকেই নাতাশার প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ করেছে মিঠু । ওর চোখগুলো বিষন্ন, কথা বলে ধীরে ধীরে আর নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে, মিঠু একরকম জোর করেই ওর ফেইসবুক আইডি চেয়ে নিয়েছে ।
সন্ধ্যায় বাবা বাসায় এলে এক মহাকান্ড শুরু হয়, স্যাভলন দিয়ে গোসল, মাস্ক গ্লাভস সব ওয়াশ করা বাবাকে ভীষণ অস্থির করে তোলে মা । মাঝে মাঝে মিঠুর মনে হয় মা কি মানসিক রোগী ? সব কিছুতেই এতো বাড়াবাড়ি ? মিঠুর জীবনের সব কিছুতে মা নাক গলাবেই, এতে কি খুব ভালো হচ্ছে ? নাকি লুকানোর প্রবণতা আরো বেড়ে গেছে ?
মুস্তাফিজ অফিস থেকে শুনে এসেছে সবাই চাল ডাল শুকনো খাবার স্টক করছে । সানজিদাকে একথা বলার পর সেও বললো ওর পরিচিত সবাই চাল -ডাল দরকারি জিনিস সব কিনে রাখছে, সামনে কঠিন সময় আসতে পারে, সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে টাকা দিয়েও কিছু পাওয়া যাবে না । মুস্তাফিজ বললো ছুটির দিনে যাবো , কিন্তু সানজিদা বললো না এখনই যাও , ডাবল দাম দিয়ে কেন কিনবো , তাছাড়া মাছ আনতে হবে, মুরগি আনতে হবে এখনই যাও, না হলে ড্রাইভারকে নিয়ে আমি যাবো ।
মুস্তাফিজ গাড়ি নিয়ে বাজারে বের হতে গেলে মিঠু বাবার সাথে যেতে চাইলো, সানজিদার নিষেধ উপেক্ষা করে বাবার সাথে বাজারে চলে গেলো । নাতাশাকে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজের সামনে আসার জন্য বলা ছিল, ওখানেই দেখা হলো । মুস্তাফিজ ছেলের মতিগতি ভালোই জানে, এক সময় নিজের এই ধাত ছিল । বন্ধুবান্ধব, হৈ চৈ, মেয়ে বন্ধু এসব করে কাটানো, কিছু সময়ের জন্য ছেলেকে ছেড়ে দিলো মুস্তাফিজ । বাজারে অসম্ভব ভীড়- বিশেষ করে চাল ডাল তেলের দোকানে, দাম কিছু বেড়ে গেছে, লোকজন ঝগড়া করছে দোকানিরা জিনিস বিক্রি করতে পেরে বাহাদুর মনে করছে । সানজিদার লিস্ট ধরে ধরে জিনিস কিনতে কিনতে মুস্তাফিজের অবস্থা গলদঘর্ম । ওর মাথায় কে যে এসব ঢোকায় ? পুরো বাজার মাথায় করে নিয়ে আসতে হবে, রিডিকুলাস । বড় আপার মিলাদ অনুষ্ঠান থেকে আসার পর থেকে এমন শুরু করেছে, সারাদিন হাত ধুতে ধুতে হাতের চামড়া তুলে ফেলেছে । নিজে ঘর থেকে বের হচ্ছেনা আর মিঠুকেও বাইরে যেতে দিচ্ছেনা এমনকি ছাদে যেতে দিচ্ছে না । প্রটেকশন নিয়ে সব কিছুইতো চালিয়ে নিতে হবে, মুস্তাফিজের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আগারগাঁয়ে, অফিসে লোকজন কম আসছে, যারা আসছে বাধ্য হয়েই আসছে অফিসটাও কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে । সব প্রোগ্রাম , একটিভিটি প্রায় বন্ধ শুধু ডেস্ক ওয়ার্কগুলো চলছে । চলছে শুধু মিটিং আর মিটিং, বড় বসরা খালি হুমকি -ধামকি দিচ্ছে ।
বাজারে আসার পর সানজিদা তিনবার ফোন দিলো নতুন সব আইটেম আনার জন্য, কালিজিরা, মেথি, থানকুনি পাতা, গিনি শাক এসব সে কিছুক্ষন আগে ফেসবুকে দেখেছে, খেলে রোগ সংক্রমণ কম হয় । মাছের বাজারে ঢুকতে কখনোই ভালো লাগে না মুস্তাফিজের, কেমন একটা টক টক পচা গন্ধ, গা গুলিয়ে ওঠে , পায়ে জুতা থাকাতে ভেজাভাবটা অনুভব করলো না । কই, শিং, মলা, কাতল বেশ কিছু মাছ কিনে মাছের বাজারের বাইরে আসতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু উৎপলের সাথে দেখা । অনেকদিন পরে দেখা হওয়াতে দুজনেই খুব উচ্ছসিত হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো, আবার মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো । উৎপল বললো দেখ কি অবস্থা, এই করোনা যে কোথায় নিয়ে আমাদের ফেলবে কিছুই বলা যায় না, সব লক ডাউন হলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে হু হু করে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিতে ধস নেমে গেছে, কি হয় কিছুই বলা যায় না, মুস্তাফিজ বললো দুশ্চিন্তা করিসনা এটার প্রতিষেধক বেরিয়ে গেলে আর সমস্যা থাকবেনা, একটা জীবাণু সারা পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারেনা, মানুষ তার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান শক্তিশালী, অবশ্যই বীজাণুৰ বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে মানুষ জিতবে । মুস্তাফিজের ইচ্ছা ছিল দু বন্ধু মিলে গ্লোরিয়া জিনসে কফি খাবে, কিন্তু উৎপলের কি একটা জরুরি কাজের জন্য তাড়াহুড়া করে চলে গেলো । মুস্তাফিজ বাজার থেকে বেরিয়ে এলো, উৎপলের ছোঁয়াটা তার ভালো লাগেনি, কেমন গা শিরশির করছে , বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ছে, হেন জিনিস নাই উৎপল খেত না ! পূজার সময় একবার বড় এক কচ্ছপ নিয়ে আসলো জসিমুদ্দিন হলে, ছেলেরা সারারাত ধরে হৈ হৈ করে সেই কচ্ছপ রান্না করে খেয়েছিলো হলে, মুস্তাফিজের এখনো কেমন গা গুলিয়ে উঠলো । শরীর একটু ব্যাথা করছে চোখ ব্যাথা করছে, দ্রুত গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে যেতে বললো বাসার দিকে, মিঠুর কথা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছিলো, লালমাটিয়া ফিজিক্যাল কলেজের কাছে আসার পরে মনে পরে, ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজতে চলেছে । মিঠুকে ফোন করলে ধরলোনা, কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন বন্ধ আসছে । এদিকে সানজিদা বার বার ফোন করতে লাগলো, ওর ফোন কেটে দিয়ে মুস্তাফিজ আবার মোহাম্মদপুর বাজারের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলো । সানজিদা আবার ফোন করলে মুস্তাফিজ বললো আসতে আর একটু দেরি হবে । আরো ঘন্টা খানিকের মধ্যে মিঠু ফিরে না আসলে বাজার নিয়ে বাসায় চলে এলো । সানজিদা মুস্তাফিজকে একা ঢুকতে দেখে বললো এই সন্দেহটাই করছিলাম, ওকে কোথায় রেখে এসেছো ? যাও আমার ছেলেকে নিয়ে আসো।
সানজিদা প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো মিঠু একজন ম্যাচিউরড ছেলে, ওর বন্ধুদের সাথে হয়তো দেখা করতে গেছে, ডোন্ট ওরি ধৈর্যহারা হইওনা, কিছুক্ষন অপেক্ষা করো ফিরে আসবে । সানজিদা সারা বাড়ি মাথায় করে নিলো, মিঠুর বন্ধুদের বাড়িতে ফোন করতে লাগলো, ড্রাইভারকে নিয়ে আবাহনী মাঠের পাশের চায়ের আড্ডাও দেখে এলো, কোথাও নেই, ফোন বন্ধ ।
মাছ মাংস বাজার সব পরে রইলো ছুটাবুয়াও দুদিন ধরে আসছেনা তার জ্বর হয়েছে ।
মুস্তাফিজ ড্রয়িং রুমে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেতে লাগলো, টিভিতে করোনা নিয়ে খবর চলছে, আজ নিয়ে বাংলাদেশে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে । ফেসবুকে একটা খবর ছড়াচ্ছে চীনারা এই জীবাণু নিয়ে রিসার্চ করেছে অনেক আগেই, তারাই এটা ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যাবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য, নিজেদের হাতে পুরো বিশ্বের কর্তৃত্ব নেয়ার জন্য, জাপানিরা ভ্যাকসিন বানিয়েছে, ম্যালেরিয়ার ওষুধ রেকনিল খেলে করোনা ভালো হয়ে যায় - কত কি নিউজ । সানজিদা চিৎকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো । রাত সাড়ে দশটার দিকে কলিং বেল বেজে উঠলো, মিঠু কাচুমাচু হয়ে নিজের ঘরের দিকে গেলো । এই কয়েক ঘন্টায় বাসায় যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে, মুস্তাফিজ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো মিঠু এতক্ষন কোথায় ছিল ? ফোন কেন বন্ধ রাখলো ? ছেলের সাথে এতো দূরত্বজ্ঞাপক সম্পর্ক কিছু জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করে না, গোসলের পর খুব ক্লান্ত লাগতে শুরু করলো, দ্রুত খাবার খেয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লো মুস্তাফিজ ।
মিঠু আজ খুব উত্তেজনার মধ্যে কাটিয়েছে, নাতাশাকে নিয়ে আসিফের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলো ধানমন্ডি ৩৩ নাম্বারে , আসিফের বাবা-মা কানাডাতে, একজন কেয়ারটেকার শুধু বাসা পাহারা দেয়, আসিফ আজ নাতাশাকে নিয়ে যাওয়াতে একটু অবাক হলো, তবে মিঠুর সাথে ওর বন্ধুত্ব এমন যে মিঠুর সব কিছুতেই আসিফ হেল্পফুল । মিঠু কল্পনাও করতে পারে নাই এই পরিস্থিতিতে নাতাশা ওর সাথে এতোটা সময় কাটাবে, আজ চরম একটি উত্তেজনাকর সময় কেটেছে । মিঠু এর আগেও কয়েকজন মেয়ের সাথে ব্যক্তিগত সময় কাটিয়েছে কিন্তু নাতাশা যেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া, ওর প্রতিটি স্পর্শ ভিন্ন এক জগতে নিয়ে গিয়েছিলো, খুব ভালো একটা অনুভূতি নিয়ে মিঠু বাসায় ফিরেছে, এই অবস্থায় মা -বাবার কথা ভাবার অবস্থায় ছিলোনা সে । না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো মিঠু, সানজিদা এসে দরজায় কিছুক্ষন ধাক্কাধাক্কি করে চলে গেলো, আজ যদি মিঠু তোমার কিছু হয়, আমি তোমার বাবাকে ছাড়বো না, বাজার - টাজার তুলে , সব ঠিক করে ঘুমাতে ঘুমাতে সানজিদার অনেক রাত হয়ে গেলো, ভোর রাতের দিকে মুস্তাফিজ বিছনার এপাশ -ওপাশ করতে লাগলো , সানজিদা বললো তোমার গা এতো গরম কেন ?
মুস্তাফিজের শরীরে অনেক জ্বর, থার্মোমিটারে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এলো, গলা ব্যাথা করছে, সানজিদার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলো, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না, ভোর হওয়া পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করলো, মিঠু এসে বাবার মাথায় পানি ঢালতে লাগলো জ্বর নামানোর জন্য, মুস্তফিজ বললো আমার কিছু হবে না, তোমরা অস্থির হইওনা, আমার ঘরে এসো না, অন্য ঘরে থাকো । আমার ঘরে কিছু খাবার, পানি আর পারাসিটামল দিয়ে যাও । সকালে সানজিদা ভাবলো মিঠুকে বড় আপার বাসায় পাঠিয়ে দেবে, কিন্তু এই অবস্থায় পাঠালে সন্দেহ করতে পারে, মিঠুর বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত হলো । সানজিদা লাজ ফার্মা থেকে কিনে আনা মাস্ক, গ্লাভস পরে কাজ করতে লাগলো, এই কয়দিন যে ভয়ের মধ্যে ছিল সবাই আজ তাই ঘরে এসে হাজির, পরিচিত এক ডাক্তারকে ফোন করে ঠান্ডা -জ্বরের কিছু ওষুধ নেয়া হলো, ডাক্তার কেন যেন করোনার ভয়ই করলো, বললো কয়েকদিন দেখেন, জ্বর না গেলে বা শ্বাস কষ্ট হলে সাথে সাথে হসপিটালে নিয়ে যাবেন, ব্লাড টেস্টগুলো করতে হবে । কেন যে মুস্তাফিজকে বাজারে পাঠাতে গেলাম ? রাগে সানজিদা চুল ছিড়তে লাগলো , বড় আপার ছেলেরা শুনে আইইডিসির এ নিয়ে ব্লাড টেস্ট করতে বললো , সবাই আলাদা ঘরে রাখতে বললো , কয়েকদিন জ্বর চলার পর শরীর খারাপ হলো , শ্বাস কষ্ট শুরু হলো, এই অবস্থায় বাসায় রাখা ঠিক হবে না ভেবে মুস্তাফিজের মামাতো ভাইকে খবর দেয়া হলো হসপিটালে নিতে হেল্প করার জন্য, মামুন গাইগুই করে শেষ পর্যন্ত এলো না, অ্যাম্বুলেন্স কল করে জাপান -বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো, ওখানে কিছু টেস্ট করে অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআর এ নিয়ে যেতে বললো, মুস্তাফিজকে ওখানে নিয়ে গিয়ে অনেক ঘোরাঘুরির পর করোনা টেস্ট করানো গেলো না, জাপান -বাংলাদেশের কাগজ দেখে অনেকে ওখানে ট্রিটমেন্ট করতে বললো, মিঠুকে নানা প্রশ্ন করা হলো, বাসায় বিদেশ থেকে কেউ এসেছে কিনা, মুস্তাফিজ কোথায় কোথায় যায়, ঐদিন কোথায় গিয়েছিলো, মাস্ক পরে কিনা, শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে তিনজন বাসায় ফিরে আসলো । সাত দিন ভোগার পর মুস্তাফিজের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়লো, ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো, ওখানকার ওয়ার্ডে মুস্তাফিজের মৃত্যু হলো । কেমন ভোজবাজির মতো সব হলো, সানজিদা কিছুই বুঝতে পারলো না, মিঠু বাবাকে হারিয়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লো, এদিকে বাসার চারপাশে লোকের ভিড় জমে গেলো, সবাই বলাবলি করছে এদেরকে আর এই ফ্ল্যাটে থাকতে দেয়া যাবে না, বাড়িওয়ালা সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, লোকজন জানালায় ঢিল ছুড়ে মারছে, পুলিশ এসে সারা বাড়ি ঘিরে রাখলো , কাউকে বাড়ির বাইরে যেতে দিলো না, ঢুকতে দিলো না, ভিড় করে লোকজন লালমাটিয়া সি ব্লকের কোনার দিকের সাদা রঙের বাড়ির সামনে ভিড় জমাতে লাগলো, বাড়িটাকে লক ডাউন করে দেয়া হলো । মুস্তাফিজ মারা গেলো কিন্তু কি রোগে মারা গেলো তা পরিবারকে কনফার্ম করা হলো না, করোনায় মারা গেলো নাকি চিকিৎসার অভাবে ? পত্রিকার লোকেরা অনেক মুখ -রোচক গল্প বানালো, কেউ বললো করোনায় মারা গেছে, পুরো বাড়ির বাসিন্দারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছে, কেউ বললো হার্ট ফেল করেছে, নিউমোনিয়ায় মারা গেছে, লাশ পুড়িয়ে ফেলা দরকার, লাইভ টেলিকাস্ট করা হলো, মুস্তাফিজকে বিশেষ এক বাহিনী কবর দেয়ার জন্য নিয়ে গেলো, কাউকে লাশ দেখতে দেয়া হলো না। গোসল, জানাজা কিছুই হলো না, সানজিদা ভাবলো মুস্তাফিজ সারা জীবন ধর্ম -কর্ম কিছুই পালন করে নি, তার শেষ সময়েও একই অবস্থা হলো, লাশের কোনো পোশাক পড়ানো হলো না, যেই কফিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটা থেকে দশ ফিট গভীর গর্তে ছুড়ে ফেলা হলো মুস্তাফিজকে, আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ এলোনা , আসলেও বাড়িতে ঢুকতে পারলো না । বাড়িওয়ালা ওদেরকে বাসায় থাকতে দিলো । মা আর ছেলে চাল ডাল ফুটিয়ে খেতে লাগলো। এভাবে তাদেরকে কতদিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে কেউ বলতে পারে না , মিঠু মন খারাপ করে বাবা -মার্ ঘরে এসে বসে থাকতে লাগলো, নাতাশাকে ফোন করলে সে ফোন কেটে দিতে লাগলো একসময় নাতাশার নম্বর বন্ধ দেখাতে লাগলো । চারতলা বাসার জানালা দিয়ে সাতমসজিদ রোড দেখা যাচ্ছে, দুই একটা রিকশা প্রাইভেট কার, খুব অল্প কয়েকজন দিন মজুর হেঁটে যাচ্ছে চারদিকে শুনসান অবস্থা, ঘরে থাকতে থাকতে মিঠুর দম বন্ধ হয়ে আসছে, মার্ সাথেও কথা বলতে ইচ্ছা করে না, দিন রাত ফেসবুক, গুগল সার্চ দিয়ে কাটছে, সানজিদা রান্না বান্না ছাড়া খুব কম নিজের ঘর থেকে বের হচ্ছে, সারাদিন নামাজ কালাম করে আর উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করে তার দিন কাটতে লাগলো, মুস্তাফিজের জন্য কোনো দোয়ার আয়োজন করা গেলো না ।
মিঠু জানালার পাশে চেয়ার নিয়ে বসে থাকে সারাদিন, দুই এক সময় ধুলা পড়া গিটার হাতে নিয়ে বাজাতে চেষ্টা করে, বাইরে কোথাও ধুপ জ্বালানো হয়েছে, ধূপের ধোঁয়া ঘরে এসে প্রবেশ করছে, ধূপের ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করতে লাগলো, মিঠু খুব জোরে শ্বাস টেনে ধূপের গন্ধে বুক ভরিয়ে নিলো, তার মনে হলো মানুষ হয়তো এসব বিপর্যয় কাটিয়ে উঠবে, আবার সবাই ঘরের বাইরে আসবে, খেতে ফসল ফলাবে, জালে মাছ ধরবে , কলকারখানায় কাজ চলবে, অফিস -আদালত সরব হয়ে উঠবে, পার্কে বসে প্রেমিক -যুগল প্রেম করবে, অনেকে নিষিদ্ধ এলাকায় যাবে কিন্তু সেই মানুষের ভিতরে যে এতো বড় একটা নৃশংস প্রবৃত্তি বাস করে তার কথা কেউ কোনোদিন ভুলতে পারবে না , মানুষ মানুষকে যে কতটা ঘৃণার চোখে দেখতে পারে , একা করে দিতে পারে, তা মন থেকে মুছে ফেলা এতো সহজ নয় । দূরে কোথাও ফুল ফুটেছে , সেই ফুলের তীব্র সুগন্ধ আসছে, ফুলের নামটি মনে করতে পারলো না মিঠু, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, একটা ছোট চড়ুই জানালায় এসে বসলো, মিঠুর মুখোমুখি তাকিয়ে আছে , মিঠু ভাবলো এই যে প্রাণ এর জন্যইতো সব কিছু , তাকে ভালো রাখতে হবে , ভালো বাসতে হবে , তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে হতে পারে, আজ যে কঠিন পরীক্ষায় মানুষ পড়েছে তা থেকে বের হওয়ার পথ তাকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে , হয়তো সে তা পারবে , বাইরের জ্বলজ্বলে আলোর দিকে তাকিয়ে মিঠুর মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো , দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০২০
এএটি