আহসান হাবিব বিপু নেমেছিলেন বদলি হিসেবে। তাতে কীইবা যায়-আসে! তিনি এখন নায়ক।
তাদের ডাক শোনা হয়েছে। উৎসবে মেতেছে সাদা-কালো গ্যালারি, ক্লাবটার ওই রঙের পতাকা হাতেই ফুটবলাররা ছুটে গিয়েছেন গ্যালারিতে। বহু বহু বছর পর দেশের ফুটবল যেন খুঁজে পেয়েছে অনেকদিনের পুরোনো সেই স্বাদ। যেই স্বাদে গ্যালারি দু ভাগ হয়, রোমাঞ্চের দেখা মেলে সেখানে, মারামারিতেও জড়িয়ে পড়েন দুই পক্ষের সমর্থকরা; দিনশেষে হয় আনন্দ, উৎসবও। ফেডারেশন কাপের ফাইনাল সবকিছুর শেষে ফিরিয়ে আনে জৌলুস, দেশের ফুটবল নিয়ে আনন্দ-বিষাদে ডুবতে পারার চেনা, অথচ ভুলে যাওয়া মধুর স্মৃতি।
মঙ্গলবার কুমিল্লার শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে আবাহনীকে হারিয়েছে মোহামেডান। ৪-৪ গোলে নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হয়। ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপ ও নয় বছর পর শিরোপা জিতেছে মোহামেডান। সবশেষ ২০১৪ সালের স্বাধীনতা কাপ জিতেছিল সাদা-কালো জার্সিধারীরা।
নির্ধারিত ৯০ মিনিট ৩-৩ গোলে সমতায় শেষ হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও ৪-৪ গোলের সমতা। শেষ পর্যন্ত ৮ গোলের এই নাটকীয় ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিল টাইব্রেকার। যেখানে পেনাল্টি মিস করেন আবাহনীর দুই বিদেশী খেলোয়াড় রাফায়েল আগুস্তো ও দানিয়েল কলিনদ্রেস। অন্যদিকে মোহামেডানের হয়ে একটি পেনাল্টি মিস করেন শাহরিয়ার ঈমন। তবে এরপর চতুর্থ শট নিতে আসা কামরুল ইসলাম জাল খুঁজে পেলে উল্লাসে মেতে ওঠে মোহামেডান।
কুমিল্লার ধর্মসাগর পাড়ে ম্যাচের শুরুতে তেমন উত্তেজনা ছিল না। তবে যত সময় গড়িয়েছে ম্যাচের উত্তেজনার পারদ ততই তুঙ্গে উঠেছে। প্রথমার্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়া মোহামেডান দারুণ এক প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখেছে দ্বিতীয়ার্ধে। মোহামেডানের সোলেমান দিয়াবাতেও গড়েছেন নতুন এক ইতিহাস। ফেডারেশন কাপের ফাইনালে প্রথম চার গোল করলেন তিনি।
প্রথমার্ধের পুরোটা সময়ই মোহামেডানের ওপর চড়াও হয়ে খেললো আবাহনী। একের পর এক আক্রমণে মোহামেডানের রক্ষণকে ব্যস্ত রাখলো পুরোটা সময়। তারই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় মিনিটে আরিফ হোসেনের লম্বা থ্রো-ইন হেডে ক্লিয়ার করতে চেয়েছিল মোহামেডান। ফিরতি বলে রাফায়েল আগুস্তোর হেড ক্রসবারের ওপর দিয়ে চলে যায়।
সপ্তম মিনিটে ডি-বক্সের ডান প্রান্ত ধরে এগিয়ে এসে শট করেছিলেন এমেকা। তবে তার বাঁকানো শট বারের উপর দিয়ে চলে যায়। গোলের জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি আবাহনীকে। ১৫ মিনিটে এমেকার ডিফেন্স চেরা ক্রস পেয়ে যান ফয়সাল আহমেদ ফাহিম। তার নিচু শট গোলরক্ষক সুজনের পায়ে লেগে জালে জড়ায়। ১-০ গোলে এগিয়ে যায় আবাহনী।
গোল হওয়ার পর আবাহনীর সমর্থকরা উল্লাসে মেতে ওঠে। গ্যালারিতে নীল-হলুদ ধোঁয়ার মশাল জ্বালিয়ে উদযাপন করেন তারা। ২৯ মিনিটে বক্সের ডান প্রান্ত থেকে কলিনদ্রেসের ক্রস বক্সের ভেতর পেয়ে যান এমেকা। দুই ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে বল দেন বাঁ প্রান্তে থাকা ফয়সালের কাছে। তার শট রুখে দেন মোহামেডানের গোলরক্ষক।
৪৩ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কলিনদ্রেস। মাঝ মাঠ থেকে লম্বা করে বল বাড়ান হৃদয়। বক্সের ভেতর বল পেয়ে যান কলিনদ্রেস। দ্রুত গতির শটে দূরের পোস্টে বল জালে জড়িয়ে দলকে ২-০ গোলের লিড এনে দেন তিনি।
তবে দ্বিতীয়ার্ধে বদলে গেল খেলার দৃশ্যপট। বদলে যাওয়া এক মোহামেডানকে দেখা গেল মাঠে। আক্রমণের ধার বাড়িয়ে দেওয়া মোহাডােনকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হলো আবাহনীকে।
বিরতি থেকে ফিরে দ্বিতীয় মিনিটেই ব্যবধান কমানোর সুযোগ এসেছিল মোহামেডানের সামনে। বলতে গেলে ম্যাচে তাদের এটাই তাদের প্রথম সুযোগ। উজবেক মিডফিল্ডার মুজাফফরজন মুজাফফরভের ফ্রি-কিক মানবদেয়ালে প্রতিহত হলে ফাঁকায় বল পেয়েছিলেন সুলেমান দিয়াবাতে। মোহামেডান অধিনায়কের শট কর্নারের বিনিময়ে ফেরান আবাহনীর এক খেলোয়াড়।
আক্রমণাত্মক ফুটবলে মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে জোড়া গোলে মোহামেডানকে সমতায় ফেরান সুলেমান দিয়াবাতে। ৫৬ মিনিটে বক্স বরাবর কামরুল ইসলামের শটে বল বিপদমুক্ত করতে ব্যর্থ হন রহমত মিয়া। ফাঁকায় বল পান দিয়াবাতে। তার প্লেসিং শট আবাহনী গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেলকে ফাঁকি দিয়ে জড়ায় জালে।
প্রথম গোলের চার মিনিট পর আবারও সুলেমান জাদু। ৬০ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে মুজাফফরভের শট ফিস্ট করে ফেরান আবাহনী গোলরক্ষক সোহেল। তার ফিস্টে বক্সের বাঁ প্রান্তে বল পান জাফর ইকবাল। জাফরের শট থেকে লাফিয়ে হেডে বল জালে জড়িয়ে মোহামেডান সমর্থকদের উল্লাসে ভাসান দিয়াবাতে।
সমতা ফিরতেই জমে ওঠে ম্যাচ। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আবাহনীর আক্রমণও। ৬৫ মিনিটে এমেকা ওগবাহর হেডে বল ফেরে ক্রসবারে লেগে। পরের মিনিটেই গোল করে সেই আক্ষেপ মেটান আবাহনীর নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড। ফয়সাল আহমেদ ফাহিমের শট ঝাঁপিয়ে ফিস্ট করেছিলেন মোহামেডান গোলরক্ষক সুজন হোসেন। সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ওগবাহ। সুজনের গ্লাভসে লেগে ফিরে আসা বলে আলতো টোকায় বল জড়ান জালে।
৮৩ মিনিটে আবারও আবাহনীর জন্য বিপদ হয়ে ওঠেন দিয়াবাতে। চিরপ্রতিন্দ্বন্দ্বিদের রক্ষণ ভেঙে ঠিকই তুলে নিয়েছেন হ্যাটট্রিক। কামরুল ইসলামের কর্নার থেকে দিয়াবাতের হেড দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আবাহনী গোলরক্ষকের। ফেডারেশন কাপের ৪৩ বছরের ইতিহাসে ফাইনালে এটিই প্রথম হ্যাটট্রিক।
অতিরিক্ত সময়ে প্রথম গোলে শট নেয় মোহামেডান। মুজাফরভের পাস থেকে নেয়া এমানুয়েল সানডের শট ঝাপিয়ে পড়ে তালুবন্দী করেন আবাহনীর গোলরক্ষক শহীদুল আলম।
ম্যাচের ৯৫ মিনিটে রাফায়েল আগুস্তোর শট কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন মোহামেডানের গোলরক্ষক সুজন হোসেন। পরের মিনিটেই কলিনদ্রেসের কর্নার থেকে বাবলুর হেড ফিরিয়ে দেন সুজন।
ম্যাচের ১০৫ মিনিটে পেনাল্টি পায় মোহামেডান। স্পটকিক থেকে দলকে এগিয়ে দেন দিয়াবাতে। ফেডারেশন কাপের ফাইনালে প্রথম ফুটবলার হিসেবে চার গোলের কৃতিত্ব গড়লেন এই ফুটবলার।
মোহামেডান যখন নিশ্চিত জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ম্যাচে নাটকীয় মোড়। ১১৮ তম মিনিটে রহমতের গোলে সমতায় ফেরে আবাহনী। বক্সের বাইরে থেকে রহমতের শট ঝাপিয়ে পরেও ঠেকাতে পারেননি বদলি গোলরক্ষক বিপু। তার হাতে লেগে বল জালে জড়ালে খেলায় ৪-৪ গোলের সমতা আসে। শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। যেখানে প্রথম শটেই মোহামেডানকে এগিয়ে দেন দিয়াবাতে। কিন্তু আবাহনীর হয়ে মিস করেন আগুস্তো।
দ্বিতীয় শটেও গোলের দেখা পায় মোহামেডান। আলমগীর কবির রানার শট ঠেকাতে পারেননি আবাহনী গোলরক্ষক সোহেল। বিপরীতে এমেকা বল জালে জড়িয়ে কিছুটা স্বস্তি ফেরান আবাহনী শিবিরে। তৃতীয় শটে মোহামেডানের হয়ে রজার ও আবাহনীর হয়ে গোল করেন ইউসেফ মোহাম্মদ। এরপর মোহামেডানের শাহরিয়ার ইমনের শট ঠেকিয়ে দিয়ে রোমাঞ্চ জাগিয়ে তোলেন সোহেল। কিন্তু সেটা খুব বেশিক্ষণ টেকেনি। কেননা আবাহনীর অন্যতম ভরসার জায়গা সেই কলিন্দ্রেসই মিস করে বসেন পেনাল্টি। দুটো পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিনশেষে মোহামেডানের নায়ক বনে যান বিপু।
১৪ বছর আগের ফেডারেশন কাপে আবাহনী-মোহামেডান ফাইনাল ম্যাচটিও গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। সেখানে শিরোপা উঠেছিল মোহামেডানের ঘরে। আজ আবারও আকাশী-নীলদের হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুললো সাদা কালোরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৬ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০২৩
এআর/এমএইচবি/এএইচএস