ঢাকা, বুধবার, ২৭ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ১৬ বছরের ‘আমলনামা’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, স্পোর্টস  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪
বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ১৬ বছরের ‘আমলনামা’

তর্কাতীতভাবে দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় নাম কাজী সালাউদ্দিন। দেশের ফুটবলের এই মেগাস্টার একসময় নিজের খেলা দিয়ে সকলের মন জয় করেছেন।

কিন্তু বিপরীত চিত্র সংগঠক সালাউদ্দিনের। টানা ১৬ বছর বাফুফে সভাপতির দায়িত্বে থাকাকালীন অবস্থায় তাকে নিয়ে সমালোচনাই হয়েছে বেশি।

চলুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক বাফুফে প্রধান কাজী সালাউদ্দিনের 'আমলনামা':

২০০৮ সালে ২৮ এপিল বাফুফে সভাপতির দায়িত্ব নেন কাজী সালাউদ্দিন। সকলের প্রত্যাশা ছিল তার হাত ধরে বদলে যাবে দেশের ফুটবলের চিত্র। উন্নয়নের সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠবে দেশের ফুটবল। কিন্তু তেমনটা হয়নি। তার নির্বাচিত হওয়ার বছরে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম স্থানে। এরপর অবনমন হতে হতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৯৭-এ। যদিও সর্বশেষ র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৪। অর্থাৎ তার দায়িত্ব নেওয়ার পর ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের উন্নতি হয়নি। বরং আগের অবস্থানেও ফিরতে পারেনি।  

জাতীয় দলের সাফল্যহীন থাকা সভাপতি সালাউদ্দিনের জন্য চেয়ে বড় ব্যর্থতা। দীর্ঘ সময় দায়িত্বে থাকার পরও জাতীয় দলের উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য নেই। এই ব্যর্থতার দায় সভাপতি হিসেবে তার ওপর বর্তায়। তার সময়ে কোনো আধুনিক ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরি হয়নি। দীর্ঘ ১৬ বছরে কাজী সালাউদ্দিন দেশের ফুটবলের জন্য কোনো বিকল্প মাঠও তৈরি করতে পারেননি। এখনও দেশের ফুটবল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামকেন্দ্রিক। দীর্ঘ সময় ধরে এই মাঠের সংস্কার কাজ চলার কারণে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হিমশিম খেতে হয়েছে বাফুফেকে। দেশের বৃহৎ ক্রীড়ামোদী শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের তৈরি করা বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনা হয়েছে বাফুফের অন্ধের ষষ্ঠি।

ছেলেদের জাতীয় দলে সাফল্য না মিললেও বয়সভিত্তিক (অনূর্ধ্ব -২০) সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ছেলেদের ফুটবলে সাফল্য বলতে এতটুকুই। তবে নারী ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বয়সভিত্তিক নারী সাফে আরও দুটি শিরোপা রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এরপরও দেশের নারী ফুটবল হেঁটেছে উল্টোপথে। তেমন উন্নতি হয়নি তাদের। উল্টো নিজেদের সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা নিয়ে রীতিমতো কর্মবিরতিতে যেতে হয়েছে নারী ফুটবলারদের। বেতন বৃদ্ধি করে চুক্তির আওতায় আনলেও নিয়মিত বেতন মেলেনি নারী ফুটবলারদের। অর্থের সংকটের কথা বলে নারী দলকে অলিম্পিক বাছাই খেলতে বিদেশেও পাঠায়নি বাফুফে।

২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলবে এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। তবে সেই মিশনের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি মাঠের ফুটবলে। উল্টো ভুটানের মতো দলের চেয়েও র‍্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। সিশেলসের মতো অপেশাদার দলের কাছেও হারের লজ্জা সঙ্গী হয়েছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের।  

কাজী সালাউদ্দিন যখন ‍বাফুফে সভাপতি হন ঘরোয়া লিগ ছিল অনিয়মিত। দেশের লিগ নিয়মিত করেছেন তিনি। তবে লিগের মান উন্নয়ন করতে পারেননি সেভাবে। ক্লাবগুলোকে অ্যাকাডেমি, বয়সভিত্তক দল গঠন কিংবা নারী ফুটবলে অংশগ্রহণের জন্য আনতে পারেননি তিনি।  

দায়িত্ব নিয়ে কোটি টাকার সুপার কাপ আয়েজন করে চমক দেখিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। তবে এরপর আর সেই সুপার কাপ আয়োজন করতে পারেননি তিনি। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফের নিয়মিত করার ঘোষণা দিয়ে কথা রাখতে পারেননি। নতুন বঙ্গমাতা গোল্ডকাপও এক আসরেই সীমাবদ্ধ। তার শেষ মেয়াদে আর্থিক অনিয়ম আর অসংগতির কথা বারবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অসংখ্য রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে হয়েছে। কিন্তু বারবারই যাকে ভুল আখ্যা দিয়েছেন সভাপতি।  তবে ফিফার নিষেধাজ্ঞায় মিলেছে এর প্রমাণ।

বাফুফের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর ফিফা তদন্ত করেছে, সেটাই কখনো স্বীকার করেননি কাজী সালাউদ্দিন। বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ তার পক্ষে সাফাই দিতে জুরিখে ফিফা সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন তিন সহকর্মীকে নিয়ে। সেটাও নাকি জানতেন না বাফুফে সভাপতি! পরে বাফুফের বিভিন্ন খরচে অনিয়ম, জালিয়াতি ও মিথ্যাচারের অভিযোগে ফিফা ২০২৩ সালে ১৪ এপ্রিল নিষিদ্ধ করে সোহাগকে। শুরুতে সোহাগকে বাঁচাতে চেষ্টা করলেও পরে বাফুফে থেকে তাকে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন সালাউদ্দিন। এরপর ফিফার জরিমানার কবলে পড়েন বাফুফে সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীও। বাফুফের আরও তিন কর্মকর্তা আর্থিক অনিয়মের কারণে ফিফার জরিমানার কবলে পড়েন। এসব দায় সভাপতি হিসেবে এড়াতে পারেন না কাজী সালাউদ্দিন।  

নারী দলকে অলিম্পিক বাছাই খেলতে না পাঠানোয় যখন দেশজুড়ে সমালোচনা, তখন ক্রিকেট বোর্ড সভাপতিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়ে নিজেকে আরও নিচে নামান ফুটবল সভাপতি। এখানেই শেষ নয়, ২০২৩ সালে এক আলোচনা সভার শুরুতে সাংবাদিকদের তাচ্ছিল্য করেন। এ সময় তাকে বলতে শোনা যায়, ‘জার্নালিস্টরা এখানে ঢুকতে গেলে তাদের আমার এখানে ফটো দিতে হবে তাদের মা-বাবার। আরেকটা কন্ডিশন হলো তার বাপের ফটো পাঠাবে, জুতা পরা। ঠিক আছে (হাসি)? এটা হতে হবে মেন্ডেটরি। বাপের জুতা পরা ছবি থাকতে হবে। ’ যদিও পরে তোপের মুখে ক্ষমা চান তিনি।

শুধু লিগ নিয়মিত করলেও জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের ফুটবল পায়নি কোনও সঠিক পথ। দেশের ফুটবলের পাইপলাইন তৈরিতে জেলা লিগ বড় ভূমিকা পালন করে। সেই জেলাগুলোর সঙ্গে গত দুই বছরে কোনও সভা করেননি তিনি। সালাউদ্দিন বাফুফের দায়িত্ব নেওয়ায় আশার পালে হাওয়া লাগলেও সেই আশা পূরণ হয়নি কোনো অংশেই, এমনটা বলাই যায়। অবশেষে আজ তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আসন্ন বাফুফে নির্বাচনে অংশ নেবেন না তিনি। ফলে বাফুফেতে শেষ হচ্ছে সালাউদ্দিন অধ্যায়। যে অধ্যায় নিয়ে দেশের ফুটবলে গর্ব করার সুযোগ নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশ সময়: ২২০২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪
এআর/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।