গাজীপুর: রাজধানী ঢাকার সীমানা ঘেঁষা জেলা গাজীপুর। বিশেষ শ্রেণীর জেলা হলেও নেই কোনো বিশেষ সুবিধা।
৬টি থানা নিয়ে গঠিত ৫টি উপজেলা ও ৬টি পৌরসভার গাজীপুর জেলায় প্রায় পৌনে এক কোটি লোকের বসবাস। গার্মেন্টস অধ্যুষিত এ জেলায় জনস্বাস্থ্য এখন প্রায় হুমকির মুখে।
বাংলাদেশের সব জেলার সরকারি স্বাস্থ্যসেবার চিত্র নিয়ে বাংলানিউজের বিশেষ আয়োজনে রোববার গাজীপুর জেলার সরকারি স্বাস্থ্যসেবার চিত্র উঠে এসেছে এভাবে-
১৯৮৪ সালে মহুকমা থেকে গাজীপুর জেলার যাত্রা শুরু। এ জেলায় ৬টি থানা নিয়ে গঠিত ৫টি উপজেলা। গাজীপুর সদর থানা ও টঙ্গি থানা নিয়ে গঠিত হয়েছে গাজীপুর সদর উপজেলা। এ ছাড়া বাকি ৪টি উপজেলা হলো কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ।
এছাড়া গাজীপুর জেলায় ৬টি পৌরসভা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, গাজীপুর, টঙ্গী, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ।
পৌরসভাগুলো ঘোষণা করা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ৪টি পৌরসভার কাজ চলছে।
এ ছাড়া জেলায় ৪৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। এ সব ইউনিয়নে ২শটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। সপ্তাহে শুক্রবার ছাড়া বাকি ৬ দিন ক্লিনিকগুলো খোলা থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে ৩ দিন খোলা থাকে।
গাজীপুর জেলার সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যান সহকারী মো. হাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, গাজীপুর জেলায় ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ৪টি হাসপাতাল রয়েছে।
গাজীপুর জেলায় স্বাস্থ্য বিভাগে ৯শ ৯৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে কতজন কর্মরত, তার সঠিক হিসাব দিতে পারেননি এ পরিসংখ্যান সহকারী।
জানা গেছে, জেলায় ১শ ৪০টি এমবিবিএস ডাক্তারের পদ রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি পদ শূন্য। ৪৫টি কনসালট্যান্টের পদের মধ্যে ৮টি পদ শূন্য।
গাজীপুর সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী মো. তোফাজ্জল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর ৪৫টি স্থায়ী ও ১০টি অস্থায়ী পদ খালি রয়েছে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেল, জেলা সদর হাসপাতালে একটি মর্গ রয়েছে। মর্গে কোনো ডোম নেই। মোহাম্মদ আলী নামে এক ব্যক্তি ডোমের কাজ করেন। ডোমকে মদ কিনে না দিলে লাশ না-ধরার রীতি এখনও পাল্টায়নি। ডোমঘরে মৃত লাশের কোনো রেজিস্টার দেখাতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রতিটি লাশের ময়নাতদন্ত করতে মদ কেনার জন্য ডোমকে দিতে হয় ১ থেকে ২ হাজার টাকা। এছাড়া ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ তো রয়েছেই।
পুলিশ কেসের জন্য ডাক্তারি সনদ নিতে টাকা লেনদেনের বিষয়টি এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। টাকা না দিলে সঠিক চিকিৎসা সনদ পাওয়া কঠিন। এ ছাড়া অপমৃত্যু ও হত্যার ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেওয়া হয়, টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, হাসপাতাল গুলোতে কর্মরত অধিকাংশ চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বার ও নির্দিষ্ট হাসপাতাল রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে চিকিৎসকরা হাসপাতালে আসলেও সময় শেষ হওয়ার আগেই অনেকে চলে যান।
সরেজমিন দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রত্যেকটি হাসপাতালের সামনে ৪০/৫০টি মোটরসাইকেল আসে। ওই সব মোটরসাইকেলে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টিটিভরা এসে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা অবস্থান করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিপ্রেজেন্টিটিভরা হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের নতুন ওষুধের নমুনা (স্যাম্পল)দিয়ে যান। নমুনার সঙ্গে সেলামি হিসেবে একটি ৩শ টাকার মোবাইল ফোনের কার্ডও দেওয়া হয়। আর চিকিৎসকরা এসব ওষুধ বাজারে বিক্রি করেন।
এ বিষয়ে গাজীপুর সদর হাসপাতালে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওয়ার্ড বয় বাংলানিউজকে জানান, একজন ডাক্তারের সংগৃহীত প্রতিদিনের নমুনা ওষুধ বিক্রি হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকায়। প্রতিদিন সকালে ডাক্তার ও রিপ্রেজেন্টিটিভদের ওই লেনদেনের কারণে জরুরি বিভাগে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়।
একটি সূত্র থেকে জানা যায়, জরুরি অপারেশন করার ক্ষেত্রে প্রায়ই রোগীকে নির্দিষ্ট প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে পাঠানো হয়। এ কাজের জন্য হাসপাতালে দালালরা নিয়মিত অবস্থান করেন।
এ বিষয়ে গাজীপুর সদর হাসপাতালে কর্মরত সমাজ সেবা কর্মকর্তা দেওয়ান আব্দুল আউয়াল বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে ভর্তি যে সব গরিব ও অসহায় রোগী টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারেন না, তাদের চিকিৎসার টাকা আমার দপ্তর থেকে দেওয়া হয়। চলতি বছরের আগস্ট মাসে গাজীপুর জেলা সদর হাসপাতালে ৮ জন রোগীকে ৮ হাজার টাকা চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ’
গাজীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তপন কান্তি সরকার বাংলানিউজকে জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি অত্যাধুনিক জেনারেটর এসেছে। কিন্তু, এখনো সচল হয়নি। জেনারেটরের জন্য একটি ঘর বানানো হয়েছে।
তিনি জানান, যারা জেনারেটরটি দিয়ে গেছেন, তারা আর আসেন নি। কারা দিয়ে গেল তা তিনি বলতে পারেন নি।
এর ফলে হাসপাতালে বিদ্যুৎ চলে গেলে বিকল্প বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না।
শুক্রবার গাজীপুর সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসাধীন রোগীরা চরম ভোগান্তিতে। এ বিষয়ে গাজীপুর সদর হাসপাতালে রোগীদের অভিযোগ, ঠিক মতো ডাক্তার আসেন না। নিয়মিত ওষুধ পাওয়া যায় না। হাসপাতালে পর্যাপ্ত আলোর সুবিধা নেই। বিশেষ করে ডাক্তারদের অবহেলায় রোগীরা চরম ক্ষুব্ধ।
এ সব বিষয়ে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তপন কান্তি সরকার অভিযোগ সত্য নয় বলে মন্তব্য করেন।
শ্রীপুর উপজেলার সরকারি স্বাস্থ্যসেবার চিত্র
শ্রীপুর উপজেলার সরকারি স্বাস্থ্যসেবার চিত্র নিয়ে বাংলানিউজের শ্রীপুর প্রতিনিধি আহমেদ মিলন জানান, শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এখন নিজেই নানা সমস্যায় আক্রান্ত। ৩১ শয্যার ওই হাসপাতালটি চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্স সংকট, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং সব মিলিয়ে খুবই করুণ অবস্থা।
চিকিৎসক, চিকিৎসা সরঞ্জাম, শয্যা, সার্জিক্যাল ব্যবস্থা বা সেবিকা এভাবে প্রতিটি বিভাগেই প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক জনবল এবং সরঞ্জাম নিয়ে হাসপাতাল চলছে। তাছাড়া এ হাসপাতালের দালাল চক্রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ।
কয়েকজন চিকিৎসকের যোগসাজসে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সার্টিফিকেটের ব্যবসা করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া হাসপাতালে কর্মরত নার্সরা বকশিসের নামে রোগীদের কাছ থেকে অনেকটা জোর করে টাকা আদায় করারও রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ।
প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ২ বছর আগে ৩১ শয্যা থেকে হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করার কাজ শেষ হলেও প্রয়োজনীয় জনবল ও আসবাবপত্রের অভাবে নতুন ভবনে কার্যক্রমের উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের জন্য ৩টি বাসভবন তৈরি করা হয়েছে।
বাসভবনে কর্মকর্তারা বসবাস করলেও আগামী কতদিনের মধ্যে সে হাসপাতালের নবনির্মিত ভবন উদ্বোধন হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
তবে শ্রীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীর মধ্যে শতকরা ৯৯ জনই হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়ে ভর্তি হন। কেউ কেউ প্রতিপক্ষকে মামলায় জড়াতে সার্টিফিকেট জড়াতে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
আর এটা কেন্দ্র করে শ্রীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা দালালদের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে মোট অংকের টাকা। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে শ্রীপুর থানা পুলিশ। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে মাস ছয়েক আগে একই দিন ওই হাসপাতালের ১১ জন ডাক্তারকে বদলি করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘একথাকে সরাসরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেউ কেউ হয়ত এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। ’ তবে আগের চেয়ে সার্টিফিকেটের ব্যবসা অনেকটা কমেছে বলে তিনি দাবি করেন।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতালের গাইনি ডাক্তার জহিরুন্নেছা রেণু প্রতিদিন হাসপাতালে আসেন আর যান। এছাড়া তার তেমন কোনো কাজও নেই তার। গত ২ বছর ধরে চলছে এ অবস্থা। গাইনি থাকলেও শূন্যপদে একজন অ্যানেসথেসিয়া নিয়োগ না দেওয়ার কারণে অপারেশন করানো যাচ্ছেনা কোনো গর্ভবর্তী নারীকে।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গাইনির ওই ডাক্তার।
তিনি বলেন, ‘অপারেশন ছাড়াও প্রতিদিন বহু মহিলা রোগী দেখতে হয়, আমাকে। ’
এই হাসপাতালে কোনো ধরনের কনসালট্যান্ট, মেডিসিন কনসালট্যান্ট, আর্থোপেডিকস, চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ, চক্ষু চিকিৎসক, অ্যানেসথেসিয়া এবং সার্জারির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। অথচ হাসপাতালে কাগজে-কলমে সব বিভাগেরই অস্তিত্ব রয়েছে।
আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফারহান ইমতিয়াজ বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন মারামারি, সংঘর্ষ ও হামলার শিকার হয়ে অসংখ্য রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে।
চিকিৎসক সংকটের কারণে রোগীদের ঠিকভাবে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। ৫০ শয্যা হাসপাতাল হলেও এখানে সব সময়ই শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। সঙ্গত কারণেই তাদের মেঝেতে অবস্থান করতে হয়। একটি আধুনিক ডিজিটাল এক্সরে মেশিন, আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স, ইসিজি মেশিন ও ইনকিউরেটর জরুরিভাবে প্রয়োজন।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও শ্রীপুর আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট রহমত আলী বলেন, ‘নবনির্মিত ভবনে প্রয়োজনীয় লোকবল ও আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করে খুব শিগগরিই সেটা চালুর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ’
কালিয়াকৈর উপজেলা হাসপাতালের চিত্র
এ বিষয়ে বাংলানিউজের কালিয়াকৈর প্রতিনিধি মাহবুব হাসান মেহেদী জানান, কালিয়াকৈর উপজেলা হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তি রয়েছে। নিয়মিত ডাক্তার না থাকার অভিযোগ রোগীদের।
এ ছাড়া টঙ্গী, কালীগঞ্জ ও কাপাসিয়ার সরকারি হাসপাতালগুলোতে একই ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের।
এ সব বিষয়ে গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. সৈয়দ মো. হাবিব উল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, গাজীপুরে ২১ মাস সময়ের মধ্যে কোনো দিন তিনি সকাল ৯টার পর অফিসে আসেননি।
তার জেলায় কোনো দুর্নীতি হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। ’
এমএস প্রোগ্রামে গাজীপুর জেলা ঢাকা বিভাগে প্রথম হয়েছে উল্লেখ করে সিভিল সার্জন বলেন, ‘গাজীপুর জেলা স্বাস্থ্য সেবায় অনেক এগিয়ে আছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১২
সম্পাদনা: শাফিক নেওয়াজ সোহান, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর
আগামীকাল সোমবার পড়ুন টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের প্রতিবেদন