টাঙ্গাইল: রোগী সেবার বদলে অধিকাংশ চিকিৎসক অর্থ-বাণিজ্যের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় টাঙ্গাইলে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, ১১ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ১শ ৬টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সাধারণ মানুষ উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৩শ ৫ জন কর্মরত ডাক্তারের অধিকাংশই অতি অর্থলোভে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে গুরুত্ব দেওয়ায় সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে রোগী সেবার মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
এছাড়া সরকার যে পরিমাণ ওষুধ বরাদ্দ দিয়েছে, তা থেকেও রোগীরা বঞ্চিত হওয়ায় এ ভোগান্তির মাত্রা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে।
আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে, টাঙ্গাইলের সরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিকে ডাক্তাররা রোগীপ্রতি ২ থেকে ৩ মিনিটের বেশি সময় দেননা। এতে করে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের অনাস্থা-অনীহা গড়ে উঠেছে। নিতান্তই গরিব মানুষ ছাড়া সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিতে চান না।
অপরদিকে, এরই সুযোগে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক-বাণিজ্য জমে উঠেছে। এসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, রোগীদের প্রতারণা করে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং হয়রানির ঘটনা ঘটছে।
প্রিভেন্টিভ চিকিৎসা কাজে টাঙ্গাইল জেলার ১২ উপজেলার ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্মরত ৫শ ৭৭ জন স্বাস্থ্য সহকারীর বেশির ভাগই দায়িত্ব পালনে অবহেলা এবং অনেকের কর্মস্থলে প্রায় নিয়মিত অনুপস্থিতের কারণে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা সেবার অবস্থা নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে।
জেলার ৩শ ৮৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকে নব নিযুক্ত হেলথ প্রোভাইডারদের অনুপস্থিতির কারণে মাঠপর্যায়ের এই ক্লিনিকগুলো অধিকাংশ দিনই বন্ধ থাকে। এর ফলে, গ্রামীণ জনগণ এসব ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা
টাঙ্গাইল জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে ১৯৭৮ সালের ৩০ জুন ১০০ শয্যা বিশিষ্ট টাঙ্গাইল জেলার সর্ববৃহৎ সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ২০০৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়।
এ হাসপাতালে একজন সহকারী পরিচালকসহ মোট ৫৭টি চিকিৎসক পদ রয়েছে। এর মধ্যে ইএনটি (এয়ার-নোজ-থ্রোট) কনসালট্যান্টসহ ১৫টি চিকিৎসক পদ অনেক দিন ধরে শূন্য। ৭১টি পদের মধ্যে কর্মরত নার্সের সংখ্যা ৬৭ জন।
হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা অভিযোগ করে বলেন, ‘জরুরি বিভাগসহ ওয়ার্ডে অধিকাংশ সময়ই কোনো ডাক্তার থাকে না। নার্সের সেবা পাওয়াও কষ্টকর। শুধু ছাত্রী নার্সদের সেবার ওপরই ভর্তি রোগীরা কিছুটা সেবা পান। ’
এবিষয়ে ভর্তি রোগীরা বাংলানিউজকে অভিযোগ করেন, হাসপাতালের খাবার মান খারাপ এবং খাদ্যেও পরিমাণে কম দেওয়া হয়। বাথরুম, টয়লেট অপরিষ্কার ও নোংরা এবং দুর্গন্ধযুক্ত। ওয়ার্ডসমূহও নোংরা। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেশির ভাগই দায়িত্ব পালন না করে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী পাঠানোর বাণিজ্য করেন। আবার হাসপাতালের অনেক ডাক্তার নিয়মিতভাবে বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের কার্ডিওলজি ডা. তাপস কান্তি ভৌমিক বসেন, “দেশবন্ধু ক্লিনিক”-এ। যদিও বা জেনারেল হাসপাতালে বসেন, সেখানে রোগী দেখেন “দেশবন্ধু ক্লিনিক”-এর টোকেন যে রোগী নিয়ে আসেন, শুধুমাত্র তাদেরকেই।
এমনি এক রোগী জিহাদ হাসান। তিনি অভিযোগ করে বাংলানিউজকে বলেন, “সম্প্রতি আমি টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ৫ টাকা দিয়ে একটি টিকেট কিনে ডা. তাপস কান্তি ভৌমিকের চেম্বারে যাই। সেখানে ডাক্তার আমাকে জানান- আমি এখন ব্যস্ত। আপনি ‘দেশবন্ধু ক্লিনিক’ থেকে একটি লাল রঙের টোকেন নিয়ে আসেন। ততক্ষণে পর্যন্ত আমি ফ্রি হয়ে যাবো। ”
পরে জিহাদ দেশবন্ধু খেকে ৪০০ টাকার বিনিময়ে একটি টোকেন নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে তাকে হার্টসহ ৩টি পরীক্ষা করানো কথা বলে ডা. তাপস। সেই সঙ্গে বলা হয়, এই পরীক্ষাগুলো “দেশবন্ধু ক্লিনিক” থেকেই করাতে হবে।
এছাড়া অর্থপেডিক (জুনিয়র কন্সালট্যান্ট) ডা. মোকলেস বসেন “সেফা ক্লিনিক”-এ। ডা. শহিদুল্লা কায়সার বসেন “দেশবন্ধু ক্লিনিক”-এ, জুনিয়র কন্সালট্যান্ট (গাইনি) ডা. জাকিয়া বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বসেন “এশিয়া ক্লিনিক”-এ। ডা. রেহানা “মেডিকো হসপিটাল”, সিনিয়র কন্সালট্যান্ট (মেডিসিন ও হৃদরোগ) ডা. সালাউদ্দিন “রাজধানী নার্সিংহোম”-এ, ডা. খান মো. ফায়েদুজ্জামান “আয়শা মেমোরিয়াল হসপিটাল” ও ডা. গোলাম মোস্তফা সকাল ১০টা থেকেই সন্ধ্যা পর্যন্ত “টাঙ্গাইল ফাউন্ডেশন ক্লিনিক”-এ বসে রোগী দেখেন।
এদের সারাদিনে একবার হয়ত রোগীরা জেনারেল হাসপাতালে দেখা পাওয়া গেলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা মিলছে না তাদের কাছ থেকে।
এদিকে, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ‘সমাজ সেবা অধিদপ্তর’ নামে একটি বিভাগ থাকলেও জেলার অধিকাংশ রোগীই তা জানেন না।
কালিহাতী উপজেলার আইসড়া গ্রামের ভ্যানচালক সবুর মিয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে আসেন টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে। কী হয়েছে জানতে চাইলে সবুর মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, “এখানে গরিব মানষের চিকিৎসা হয় না। এখানে আসলে প্রথমে ব্যথার একটা ওষুধ খাওয়ায়। পরে বাকি ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে বলেন। ” এখানে কোনো সরকারি ওষুধ দেওয়া হয় কিনা তা তিনি জানেন না।
সমাজ সেবা অধিদপ্তরের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেন- “এটা আবার কী!”
এরকম টাঙ্গাইল সদর উপজেলার পোড়া বাড়ি গ্রামের হাসপাতালের ৩নং ওয়ার্ডে ভর্তি আক্কাস আলী, ঘাটাইলের সোহরাব মিয়া, গোপালপুরের আনসার আলীসহ বেশিরভাগই রোগীই জানেন না এই ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর’ বিষয়ে। অথচ কাগজে-কলমে প্রতিদিন গড়ে ৭/৮জন রোগীকে এই সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় সাহায্য করা হয়েছে।
উপজেলার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা:
জেলার মধুপুর, ভূঞাপুর, সখীপুর, কালিহাতী, ঘাটাইল ও বাসাইল এই ৬ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইনডোরে শয্যা সংখ্যা প্রতিটিতে ৫০টি। প্রতিটিতে চিকিৎসক সংখ্যা ২১ জন। নার্স ১৫ জন। এছাড়া আছে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক টেকনিক্যাল স্টাফ, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীও।
এছাড়া নাগরপুর, দেলদুয়ার, মির্জাপুর, ধনবাড়ি ও গোপালপুর এই ৫ উপজেলার প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শয্যা সংখ্যা ৩১টি। চিকিৎসক সংখ্যা ৯ জন, নার্স সংখ্যা ১০ জন। এছাড়া আছেন অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্টাফ।
উপজেলাগুলোর অধিবাসীরা অভিযোগ করে বলেন, “আমরা উপজেলা হাসপাতালের আউটডোর এবং ইনডোরে সুষ্ঠু চিকিৎসা পাই না। ”
সরেজমিন দেখা গেছে, ভর্তি রোগীদের নিম্নমানের খাদ্য দেওয়া হয়। ওষুধ বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়। হাসপাতালের পরিবেশ নোংরা এবং দুর্গন্ধযুক্ত।
প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে, ৫টি থেকে ১০/১২টি বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক। এক শ্রেণীর দালাল নানান কৌশলে রোগীদের উপজেলা হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে স্থানান্তর করেন। সেখানে নানা প্রতারণার শিকার হয়ে রোগীরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চিকিৎসা সেবা পান না।
টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলার ১শ ৬টি ইউনিয়নে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেখানে প্রায় সময়ই ডাক্তারের দেখা মেলে না। চিকিৎসা সহকারীরা প্রেসক্রিপশন দিলেও ওষুধ বাজার থেকে রোগীদের কিনতে হয়।
এছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকার জনসাধারণ অভিযোগ করেছেন, উপজেলা কমপ্লেক্স এবং উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা রোগীদের দেওয়ার জন্য সরকারি ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি করে দেন।
এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানান, কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকার জন্য সরকারের কঠোর নির্দেশ থাকার পরও কর্ণপাত করছেন না চিকিৎসকরা। অথচ দীর্ঘদিন ধরে চরম অব্যবস্থাপনায় চলছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। নির্ধারিত চিকিৎসক ও সেবিকার বেশি ভাগই প্রতিদিন অনুপস্থিত থাকছেন। চিকিৎসক আর সেবিকাদের বৃহৎ অংশই নিয়মিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন না। তাদের ইচ্ছেমতো চলছে এখানকার চিকিৎসা সেবা।
উপজেলা কমপ্লেক্স এবং উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রেও রয়েছে খাবার ও ওষুধ সরবরাহে চরম অনিয়ম। তালিকা অনুযায়ী, খাবারও রোগীদের কপালে জুটছেনা। পাচ্ছেননা সুচিকিৎসা। দু’একজনের ভাগ্যে ওষুধ মিললেও অধিকাংশ রোগীরই ভাগ্যেই ওষুধ মিলছেনা।
দেলদুয়ার উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র
দেলদুয়ার উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, চরম অনিয়মের চিত্র। ৩১ শয্যা বিশিষ্ট এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দ্বিগুণ রোগীর চাপ থাকার কারণে আর কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের অনিয়মে এখানে চিকিৎসা সেবার মান নাজুক অবস্থায় পৌঁছানোর পাশাপাশি এর চরম প্রভাব পড়েছে- চিকিৎসাপ্রত্যাশী উপজেলাবাসীর ভাগ্যে।
দেলদুয়ার উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, সব মিলিয়ে প্রায় শতাধিক লোকবল রয়েছে এ কমপ্লেক্সে। এদের মধ্যে ডাক্তার রয়েছেন ১৪ জন। উপসহকারী মেডিকেল অফিসার রয়েছেন ৪ জন এবং প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে রয়েছেন ১ জন ডাক্তার।
এছাড়া হাসপাতালটির অধীনে ৩টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ৮টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। সেখানেও প্রতিটিতে ১ জন করে ডাক্তার কর্মরত থাকার কথা। যেখানে উপজেলা হাসপাতালের এই দশা, সেখানে রোগীরা উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তারের কথা কল্পনাও করতে পারেন না।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, কোনো ডাক্তারই কর্মস্থলে থাকেন না। অধিকাংশ ডাক্তারই ঢাকা ও অন্যান্য স্থান থেকে সপ্তাহে ১/২ দিন এসে ডিউটি করেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১ জন ডাক্তার ১ দিনে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থেকে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ডিউটি হিসেবে ৩ দিনের ডিউটি দেখান। এভাবে একটানা ২ দিন উপস্থিত থাকলে তার ৬ দিনের ডিউটি হয়ে যায়। এভাবে তারা পালাক্রমে প্রতিদিন ২/৩ জন করে উপস্থিত থাকেন।
ফলে, প্রতিদিন বহির্বিভাগে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২/৩ জন ডাক্তারের পক্ষে ২/৩শ রোগী দেখা সম্ভব নয়। তাই, তাদের এক মিনিটেই ২/৩ জন রোগী দেখে বিদায় করতে হয়। এছাড়া ১ জন মেডিকেল অফিসারের উপস্থিতিতে চলছে দিনের কার্যক্রম।
দেলদুয়ার টিকেট কাউন্টারের উল্টোদিকে যেখানে কর্তব্যরত ব্যক্তির থাকার কথা, সেখানে রয়েছে দুটি মোটরসাইকেল। অধিকাংশ চেয়ারে ধুলোবালি। বসার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অথচ হাসপাতালের হাজিরা থাতায় সবার নামের পাশে সাইন করানো রয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয়, হাজিরা খাতায় আরএম ও শেখ ইফতেখার রহমানের উপস্থিতি প্রতিদিন।
অথচ তিনি প্রতিসপ্তাহের সোমবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। এভাবেই চলছে বিভিন্ন উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো!
এ বিষয়ে দেলদুয়ার উপজেলার আরএম ও শেখ ইফতেখার রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।
সরকারি চিকিৎসা বাণিজ্যের সুযোগে-
এদিকে, জেলায় সরকারি হাসপাতালে সুষ্ঠু চিকিৎসা না থাকার সুযোগ লুফে নিচ্ছে সুযোগসন্ধানী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। সরকারি চাকরিরত ডাক্তাররাই মূলত এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসার কাজ করেন।
টাঙ্গাইল জেলা সদরে শতাধিক এবং উপজেলা সমূহে দেড়শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জমজমাট বাণিজ্য চালিয়ে চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া এসব ক্লিনিক হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
অকারণে পরীক্ষার নামে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা চলছে। কিন্তু, সিভিল সার্জন অফিস এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অফিস থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বেসরকারি ক্লিনিকের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
জেলায় আড়াই শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক থাকলেও সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট ৫৬টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে। এর মধ্যে ৪৮টির লাইসেন্স আছে। ৪টি লাইসেন্সের আবেদন করেছে এবং ৪টি লাইসেন্স ছাড়া বেআইনিভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবার হাল
জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ বাংলানিউজকে অভিযোগ করেন, মাঠপর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্য সহকারীদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সেবা মিলছে না।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, জেলার ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ৫শ ৯১জন স্বাস্থ্য সহকারীর মধ্যে ১৪টি পদ শূন্য। কর্মরত আছেন ৫শ ৭৭ জন। তারা মাঠ পর্যায়ে জনগণের মধ্যে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। কিন্তু, উপজেলাগুলোর তৃণমূল পর্যায়ের জনগণ অভিযোগ করেছেন, অধিকাংশ স্বাস্থ্য সহকারী নিয়মিত এলাকায় যান না। মাঝে-মধ্যে গেলেও তাদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সেবা মেলে না। ফলে, জনগণ অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলায় ৩শ ৮৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে জনগণকে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৪টি, নাগরপুরের ৩৭টি, দেলদুয়ারে ১১টি, মির্জাপুরে ৫২টি, বাসাইলে ২২টি, কালিহাতীতে ৫২টি, ঘাটাইলে ৫৪টি, মধুপুরে ২৯টি, ধনবাড়িতে ২০টি, গোপালপুরে ২৪টি, ভূঞাপুরে ২১টি এবং সখীপুরে ৩৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকে গত জুলাই পর্যন্ত সর্বমোট ৪ লাখ ৪শ ৯১জন নারী-পুরুষকে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে ৪ হাজার ২শ ২৫ জনকে চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। গ্রামীণ এলাকার জনগণ অভিযোগ করেন, কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ অধিকাংশ দিনই বন্ধ থাকে। সপ্তাহে ২/১ দিন এগুলো খোলা হলেও উপযুক্ত চিকিৎসক এবং ওষুধের অভাবে দরিদ্র জনগণ স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে আরএম ও ডা. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “সরকার প্রতিদিন ২শ ৫০ জন রোগীর জন্য ওষুধ বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু, রোজ গড়ে প্রায় ৪শ থেকে ৫শ রোগীকে ওষুধ দিতে হয়। ফলে, আমদেরও একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য সবাই ধারণা করেন, সরকারি ওষুধ বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ”
সমাজ সেবা অধিদপ্তরের বিষয়ে তিনি বলেন, “বছরে ১ লাখ টাকা সরকারিভাবে দেওয়া হয়। কিন্তু, এটা খুবই সামান্য। কারণ, প্রতিদিন গড়ে ৭/৮ জনকে এর আওতায় ওষুধ কিনে দিয়ে সাহায্য করা হয় (যদি কোনো ডাক্তার মনে করেন)।
অধিকাংশই রোগীই জানেন না, সমাজ সেবা অধিদপ্তর নামে কোনো সংস্থা গরিব রোগীদের আর্থিক সাহায্য করে। এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, আসলে তাদের টাকার বাজেট কম হওয়ায় তারাও প্রচার করে না। টাকার বাজেট যদি বেশি হতো, তাহলে হয়ত অনেককেই সাহায্য করা যেতো।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, “আমি টাঙ্গাইলে মাত্র ১০ দিন আগে এসেছি। কাগজপত্র ছাড়া যেসব ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করা হবে। আর কোনো সরকারি ডাক্তার যদি অফিস টাইমে কোনো ক্লিনিকে বসে প্র্যাকটিস করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ”
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১২
সম্পাদনা: শাফিক নেওয়াজ সোহান, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর