ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

‘দুর্নীতির খনি’গোপালগঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগ!

একরামূল কবীর, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১২
‘দুর্নীতির খনি’গোপালগঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগ!

গোপালগঞ্জ: গোপালগঞ্জ স্বাস্থ্যবিভাগের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

কেনাকাটা, নিয়োগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে এ বিভাগে পুকুর চুরি ঘটনা ঘটে।



এ বিষয় নিয়ে তদন্ত কমিটি হলেও অদৃশ্য কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। এর আগে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আগে ২ সিভিল সার্জনকে প্রত্যাহার করা হয়। এসব বিষয়ে কোনো তথ্য চেয়েও পাওয়া যায় না।

তবে সিভিল সার্জন ডা. মুহ. আছাদউজ্জামান দুর্নীর্তির কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিভাগে চিকিৎসক আছে। শূন্য পদে চিকিৎসক পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কয়েকটি গুরুতপূর্ণ শূন্যপদ পূরণ হলে সমস্যা অনেকাংশে মিটে যাবে। আপাতত হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মুনির আহমেদকে এনেসথেটিস্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি ডিপ্লোমা করেছেন। কিন্তু পাস করতে পারেন নি। তাকে দিয়ে ঠেকা কাজ করানোর জন্য বলা হয়েছে। ’

জানা গেছে, ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যাপক দুর্নীর্তি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান মিয়াসহ তার ৩ কর্মচারীকে বদলি করা হয়।  

সবাই বদলি করা স্থানে যোগদান করলেও প্রধান সহকারী জহুরুল হক মৃধা এক মাসের মধ্যে আগের কর্মস্থল গোপালগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিসে ফিরে আসেন।

অভিযোগ আছে, জহুরুল হক মৃধা স্বাস্থ্যবিভাগের বিতর্কিত ঠিকাদার মোকাদ্দেরুল ইসলাম মিঠুর একজন সহযোগী। তার প্রভাবেই তিনি দুর্নীর্তির অভিযোগে বদলি হলেও এক মাসের মধ্যে আবার আগের কর্মস্থলে ফিরে আসেন।

২০০৯-১০ অর্থ বছরে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের প্রায় ৩২ কোটি টাকার ভারী যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মালামাল বুঝিয়ে না দিয়ে জহুরুল হক মৃধার সহযোগিতায় ঠিকাদার মিঠুকে বিলের সব টাকা দিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

গোপালগঞ্জ স্বাস্থ্যবিভাগে বিভিন্ন সময়ে টেন্ডারের কোটি কোটি টাকার মালামাল বুঝে না পেয়ে ঠিকাদার মিঠুকে বিলের টাকা পরিশোধে জহুরুল হক মৃধার প্রধান ভূমিকা ছিল।

এছাড়া বর্তমান সিভিল সার্জনের সময় গোপালগঞ্জ স্বাস্থ্যবিভাগে ভারী যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মালামাল সরবরাহের প্রায় ৯ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয় গত জুন মাসে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, নীতিমালা না মেনে ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ দুই অর্থ বছরের দুটি দরপত্র একই সঙ্গে ও একই তারিখে আহ্বান করা হয়। এ সম্পর্কে তিনি (সিভিল সার্জন) কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।

তবে এসব দুর্নীর্তির সঙ্গে গোপালগঞ্জ স্বাস্থ্যবিভাগের প্রধান সিভিল সার্জনের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন গোপালগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী জহুরুল হক মৃধা ও গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের প্রধান সহকারী আবুল কালাম আজাদ।

এ বিষয়ে গোপালগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী জহুরুল হক মৃধা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এসব কাজে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব বিষয়ের দায়িত্ব সিভিল সার্জন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। ’

বদলি হওয়ার ১ মাসের মধ্যে ফিরে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডিজি অফিস আবার আমাকে গোপালগঞ্জে বদলি করেছে। এতে বিতর্কিত ঠিকাদার মিঠুর কোনো হাত নেই। ’

গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের প্রধান সহকারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি যা করেছি, তা তৎকালীন সিভিল সার্জনের নির্দেশেই করেছি। ’

হাসপাতালের কেনা-কাটার কোনো তথ্য সিভিল সার্জনের নির্দেশ ছাড়া তিনি দিতে পারবেন না বলে বাংলানিউজকে জানান।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মুহা. আছাদউজ্জামান কোনো তথ্যই সাংবাদিকদের দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। তথ্য অধিকার আইনে তথ্যের জন্য আবেদন করলে তথ্য পাওয়া যাবে কিনা জানলে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আপনাদের বিষয়। ’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৎকালীন ও বর্তমান টেন্ডার কমিটির একাধিক সদস্য ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বাংলানিউজকে জানান, স্বাস্থ্যবিভাগের বিতর্কিত ঠিকাদার মিঠুর সহযোগী সিভিল সার্জন অফিসের জহুরুল হক মৃধা। নতুন কোনো সিভিল সার্জন আসলেই তার জালে আটকা পড়ে যান। তখন আর তার (সিভিল সার্জনের) কিছু করার থাকে না। তিনি যা বলেন ও করেন, তা সিভিল সার্জনকে করতে হয়।

আর জহুরুল হক মৃধার অন্যতম সহযোগী গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের প্রধান সহকারী আবুল কালাম আজাদ। এরা প্রত্যেকেই সামান্য চাকরি করে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক এসব তথ্য চেয়ে না পেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন। তারপরও তাকে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মু. আছাদউজ্জামানকে তথ্য অধিকার সেলে হাজির হওয়ার সমন পাঠালেও তিনি হাজির হননি।

এদিকে, গোপালগঞ্জ শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার। সরকারি হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা না পেয়ে রোগীরা এসব প্রাইভেট ক্লিনিকের দারস্থ হচ্ছেন। আর এসব ক্লিনিকে অহরহ মেজর ও মাইনর অপারেশন হচ্ছে। আর অপারেশন করছেন এ হাসপাতালেরই চিকিৎসকরা।

এনেসথেসিয়াও দিচ্ছেনও এসব চিকিৎসকরা। আর শহরে গড়ে ওঠা বেশির ক্লিনিক বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের মালিক জেলায় কর্মরত সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের স্ত্রী, মা অথবা বাবা (নামে মালিক)। কিন্তু জেলা শহরের বেশির ভাগ ক্লিনিক পরিচালনা করেন জেলায় কর্মরত চিকিৎসকরা (প্রকৃত মালিক, কিন্তু সরকারি বিধিনিষেধ থাকায় তারা কাছের আত্মীয়-স্বজনের নামে রেজিস্ট্রেশন নেন)। এ ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে ওঠেন এসব সেন্টারের মালিক ও চিকিৎসকরা।  

জেলা, উপজেলা ও গুরুত্বপূর্ণস্থানে শহরে গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের রয়েছে কর্মী বাহিনী (দালাল)। তৃণমূল পর্যায় থেকে এরা রোগী ফুঁসলিয়ে এসব ক্লিনিকে নিয়ে আসেন। আর এ কাজে ওই প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করেন গ্রাম্য ডাক্তার (হাতুড়ে ডাক্তার)। রোগী এনে দেওয়া বাবদ তারা ভাতা পান (কমিশন)।

তবে, এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে রোগীদের প্রতারিত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। চিকিৎসকের অবহেলায় ও ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের পুরনো সোনালী বাংক মোড়ে সতীশ স্মৃতি আরোগ্য সদনটি পরিচালনা করে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. অসিত কুমার মল্লিক।

পাবলিক হল মোড়ের জান মোহাম্মদ প্লাজায় মালঞ্চ সার্জিক্যাল ক্লিনিকটি পরিচালনা করেন একই হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট সার্জারি ডাক্তার অনুপ কুমার মজুমদার। সাহাপাড়া রোডে গোপালগঞ্জ নার্সিং হোমটি পরিচালনা করেন গোপালগঞ্জের পার্শ্ববর্তী মোল্লারহাটি উপজেলার ইউএইচ অ্যান্ড এফপিও ডাক্তার অরুণ কান্তি বিশ্বাস। এর আগে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় একই দায়িত্বে ছিলেন।

২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের নিকটবর্তী পাঁচুড়িয়ার নিজ বাসভবনে কিত্তর হোম ক্লিনিকটির মালিক গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ইউ ইচ অ্যান্ড এফপিও ডা. চৌধুরী শফিকুল আলমের স্ত্রী। তবে, ক্লিনিকটি ডা. চৌধুরী শফিকুল আলম পরিচালনা করেন। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের নিকটবর্তী পাঁচুড়িয়ায় টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ইউএইচ অ্যান্ড এফপিও নিজ বাসভবনের গ্রুপ ক্লিনিকটির অন্যতম অংশীদার তিনি নিজে।

এ ক্লিনিকটির অংশীদার সদর উপজেলার ইউএইচ অ্যান্ড এফপিও ডা. চৌধুরী শফিকুল আলমও। শহরের বঙ্গবন্ধু কলেজে রোডের জিম ক্লিনিক পারিচালনা করেন ডা. হাফেজ মাহফুজুর রহমান। সরকারি হাসপাতালে চাকরি করা অবস্থায় তিনি এটি করেন। এ নিয়ে অভিযোগ উঠলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।

শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে জাহানারা সেবা ক্লিনিকটি পরিচালনা করেন ডা. নাসির উদ্দিন। তিনি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ইউএইচ অ্যান্ড এফপিও চাকরি করতেন। সম্প্রতি, তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। শহরের গেটপাড়ায় ভূঁইয়া ক্লিনিকটি পরিচালনা করেন মাতৃমঙ্গলের এনেসথেসিয়া ডা. মনিরুজ্জামান ও তার স্ত্রী ফরিদ মেডিকেল কলেজের গাইনি বিশেষজ্ঞ কামরুল নাহার।

গোপালগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, তাদের হিসাব মতে, জেলায় মোট ৩৫টি ক্লিনিক ও ৫০টি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে।

এর মধ্যে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ১৭টি ক্লিনিক ও ২৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কাশিয়ানী উপজেলায় ৭টি ক্লিনিক ও ৮টি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, মুকসুদপুর উপজেলায় ৪টি ক্লিনিক ও ৫টি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় ১টি ক্লিনিক ও ৩টি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার এবং কোটালীপাড়া উপজেলায় ৬টি ক্লিনিক ও ৫টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। তবে, বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১২
সম্পাদনা: রাফিয়া আরজু শিউলী ও শাফিক নেওয়াজ সোহান, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বৃহস্পতিবার পড়ুন- জামালপুর আধুনিক জেনারেল হাসপাতাল বিষয়ে প্রতিবেদন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।