বরিশাল: দীর্ঘদিন ধরে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ ( শেবাচিম) হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের কোবাল্ট ৬০ রেডিওথেরাপি মেশিন বিকল অবস্থায় রয়েছে। ফলে বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা রেডিওথেরাপি দিতে না পেরে চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন।
শেবাচিম হাসপাতালের রেডিওথেরাপি (অনকোলজি) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. আ.ন.ম. মঈনুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগের কোবাল্ট ৬০ রেডিওথেরাপি মেশিন ২০১৫ সালে অচল হয়, এরপর ২০১৯ সালে মেশিনটি চিরস্থায়ী অকেজো ঘোষণা করা হয়। এ কারণে গত নয় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ক্যানসারে আক্রান্ত

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর এ পাড়ের ১১ জেলা এবং পার্শ্ববর্তী বিভাগ খুলনা হাসপাতালেও কোবাল্ট ৬০ রেডিওথেরাপি মেশিন নেই। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র ভরসাস্থল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তবে রেডিওথেরাপি মেশিনটি নষ্ট থাকায় এখন যারা আসেন তারা মন খারাপ করে চলে যান। আর এসব রোগীর মধ্যে বেশিরভাগই আর্থিকভাবে সচ্ছল না থাকায় তাদের পক্ষে বেসরকারিভাবে কিংবা ঢাকায় গিয়ে থেরাপি দেওয়া সম্ভব হয় না।
তবে হাসপাতালের প্রশাসনিক শাখা জানিয়েছে, নতুন মেশিন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন-নিবেদন করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। তারপরও এখনো চেষ্টা চলছে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন সংযোজনের।
ভোলার বাসিন্দা মো. হাসান বলেন, ছোট ভাই দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার রেডিওথেরাপি দেওয়া প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় শেবাচিম হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়েছিলাম, তারা সেখান থেকে মহাখালীতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে সিরিয়াল দেওয়াসহ সবকিছুতেই বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। আবার ঢাকায় গিয়ে ভাইয়ের কেমো দেওয়া পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। এরই মধ্যে আমাদের পরিবারের জমি বিক্রির টাকা ভাইয়ের পেছনে শেষ হয়েছে। বর্তমানে আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যা সহযোগিতা পাই তা দিয়ে কোনোভাবে ভাইয়ের চিকিৎসা করাই। রেডিওথেরাপি দিতে না পারায় আমার ভাইয়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
নগরের পলিটেকনিক রোড এলাকার বাসিন্দা জুয়েল মাহামুদ নামে অপর রোগীর স্বজন বলেন, বাবার গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ার পর শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে যাই। হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে কেমো দেওয়া হয় এবং ওই কেমো দেওয়ার ২১ দিনের মধ্যে রেডিওথেরাপি দেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়।
এ জন্য হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় থেরাপি কোবাল্ট-৬০ মেশিন অচল। আমাদের ঢাকার মহাখালীতে পাঠানো হয়। সেখানে যাওয়ার পর ৮ মাস পর সিরিয়াল দেওয়া হয়। কিন্তু থেরাপি দিতে হবে ২১ দিনের মধ্যে। সেখানে ওই কোর্স সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার প্রয়োজন। একই থেরাপি বেসরকারিভাবে দিতে গেলে ২ লাখ টাকার প্রয়োজন। এত টাকা ম্যানেজ করা সম্ভব না হওয়ায় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে সিরিয়াল ২১ দিনের মধ্যে এনে থেরাপি দেওয়া হয়।
জুয়েল মাহমুদের মতে শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা হাসপাতালগুলোতে এ মেশিন থাকলে দরিদ্র মানুষগুলো কিছুদিন হলে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন।
শেবাচিম হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সামনে আসা একাধিক রোগীর স্বজন জানান, শেবাচিম হাসপাতালে মেশিনটি ঠিক করা হলে এখানেই রেডিওথেরাপি শুরু করা যাবে। আর ঢাকার মহাখালীতে গেলেও সিরিয়াল পড়ে ৭ থেকে ৮ মাস পর। দেখা যাবে ওই সময়ের আগেই রোগী মারা গেছে।
রোগীর স্বজন আরিফুর রহমান বলেন, ঢাকায় গিয়ে খরচ পুষিয়ে উঠতে পারবো না এমন শঙ্কায় চিকিৎসককে বলেছিলাম ওষুধ দিতে। কিন্তু চিকিৎসক জানিয়েছেন রেডিওথেরাপির কাজ ওষুধে হবে না, তাই রেডিওথেরাপি দিতেই হবে। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে যদি সরকারি হাসপাতালের সিরিয়াল না পাই তাহলে বেসরকারি হাসপাতালে লাখ টাকা খরচ করার সঙ্গতি নেই।
সার্বিক বিষয়ে শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. একেএম মশিউল মুনীর বলেন, সরকার থেকে দেশের চারটি হাসপাতালে কোবাল্ট-৬০ মেশিন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল সেখান থেকে একটি মেশিন এ হাসপাতালেও আসবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও এ মেশিনটি খুবই প্রয়োজন। সেই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৃথক ক্যান্সার হাসপাতাল হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে ওই হাসপাতালে ক্যান্সারের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি থাকবে। এতে করে এ অঞ্চলের মানুষের বিশেষ করে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা স্বল্প টাকায় চিকিৎসা সেবা পাবে। তবে এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
পরিচালক বলেন, আপনাদের মাধ্যমে সরকারের কাছে আমার একটি আবেদন থাকবে। তা হচ্ছে রোগীদের জন্য ওষুধ বিনামূল্যে না দিয়ে ক্যান্সারসহ বড় ধরনের রোগের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা দিলেও রোগীর স্বজনদের অনেক উপকার হবে। এতে করে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে, এটা হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২২ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০২৫
এমএস/জেএইচ