ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মনোকথা

রাগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য

ডা. সৃজনী আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৪
রাগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য

রাগ শব্দটির সঙ্গে কম বেশি আমরা সবাই পরিচিত। সব সময় রেগে আছেন এমন মানুষের সংখ্যা যেমন বিরল নয়, তেমনি হুটহাট রেগে যান এমন মানুষের সংখ্যাও অসংখ্য।

তবে রাগের ধরনটা যেমনই হোক না কেন তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ থাকে।

তবে এ রেগে যাওয়া বেশিরভাগ সময়ই আমাদের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনে না। উপরন্তু তা যেমন সামাজিক অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে, ঠিক তেমনি তা আমাদের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে।     

দৈনন্দিন জীবনে আমরা বহু রকমের পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পরিবেশের প্রভাব, সেই সঙ্গে ব্যক্তিত্বের গঠন অনুযায়ী আমরা একেক জন একেক ভাবে সেই পরিস্থিতিগুলো মোকাবেলা করি, আচরণ করি। অতিরিক্ত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, অসহযোগিতামূলক মনোভাব যেকোনো পরিস্থিতিতে কোনো চিন্তা না করে হঠাত্‍ একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

আর তারই তাত্‍ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা নিজের মধ্যে রাগের প্রকাশ ঘটাই, যা শরীর আর মনে প্রচণ্ড খারাপ প্রভাব ফেলে। আর সেই সঙ্গে পরিপার্শ্বিকেরও ক্ষতি করি। অথচ একটু ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে পরিস্থিতি যাচাই করে কাজ করলে আমরা এসব খারাপ প্রভাবগুলো এড়াতে পারি।

ধরা যাক, আপনি আপনার কর্মস্থলে ক্যান্টিনে খেতে গেছেন। ক্যান্টিনে প্রচণ্ড ভিড়। আপনার খাবার অর্ডার মতো আসতে দেরি হলো। যখন খাবার আসলো তখন আবার একটা পদ দেখা গেল আপনার অর্ডার না। সেই মুহূর্তে আপনি ক্যান্টিনের বেয়ারাকে মেরে বসলেন বা ভুল পদটি ছুঁড়ে ফেলে কিছুক্ষণ চিত্‍কার চেঁচামেচি করলেন। চমকে উঠলেন আপনার সঙ্গে যাওয়া সহকর্মী, আপনার খাওয়াও হলো না আর।

গোটা ঘটনাটায়তো আপনি অন্য রকম আচরণও করতে পারতেন-দৃঢ় স্বরে বেয়ারাকে ভুল পদটি পরিবর্তন করে আপনার নির্দেশকৃত পদটি আনতে বলতে পারতেন। সেক্ষেত্রে আপনার খাওয়া-দাওয়াও ঠিকমতো হতো। আপনার সহকর্মীকেও বিব্রত হতে হতো না।

এ রকম বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমরা সহিংস আর নেতিবাচক আচরণ করে নিজেদেরই ক্ষতি করি।

নেতিবাচক-আগ্রাসী মনোভাব দিয়ে আমরা যে ক্ষতি করি
১. তাত্‍ক্ষণিকভাবে আমাদের শরীরে `Sympathetic` সিস্টেম কার্যকর হয়ে শরীরে যে হরমন নিঃসরণ বাড়ে তাতে রক্তচাপ বেড়ে যায়, হৃদপিণ্ডের গতি হঠাত্‍ বেড়ে যাওয়ায় রক্ত সঞ্চালনে গোলমাল হয়, পাকস্থলিতে বেড়ে যায় অম্ল নিঃসরণ। দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে থাকলে কিংবা সব কিছুতে খিটখিটে আচরণ করলে এ প্রভাবগুলো শরীরে স্থায়ীভাবে কাজ করে।

২. রাগের ফলে সহিংস আচরণ আমাদের পারিপার্শ্বিকতাকে বিরূপ করে তোলে। নিজেদের প্রতিও আমরা অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক করে তুলি।

৩. অন্যদেরও আমরা সহিংস আচরণ শিক্ষা দিয়ে ফেলি। যে শিশুটি তার বাবাকে দেখে যেকোনো পরিস্থিতিতে সহিংস আচরণ করতে সে নিজেও তখন তার খেলার বন্ধুকে কিংবা স্কুলে সহপাঠীকে প্রহার করে বসে।

৪. অন্যের সঙ্গে সহিংস আচরণ করলে নিজেরাও সহিংস আচরণের শিকার হতে পারি প্রতি উত্তরে।

৫. রাগ বা সহিংস আচরণের পরবর্তীতে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। নিজের প্রতিও নিজের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। যেকোনো পরিস্থিতিকে তাই ইতিবাচকতার সঙ্গে, অপরের প্রতি সহমর্মিতার সঙ্গে বিবেচনা করলে এ ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানো যায়। পাশাপাশি নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করায় অগ্রসর হওয়া যায়। এর ফলে সকলের কর্মোদ্যমও বাড়ানো যায়।

কেন এমন হয়
কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে অতিরিক্ত রাগ, সহিংস আচরণ দেখা যায়। বিষন্নতা,অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তি, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া,পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার ইত্যাদি মানসিক রোগগুলোর সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ, সহিংস আচরণ দেখা যায়।

এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় চিকিত্‍সা নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও শৈশবে বিরূপ পরিবেশ, সহিংস আচরণ প্রত্যক্ষ করা, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতি, সাংস্কৃতিক শিক্ষা আমাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী সহিংস আচরণে সহায়তা করে।

যা করা যায়
এরকম ক্ষেত্রে আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে, যদি দেখি যে আমাদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব এবং আচরণ খুব বেশি হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে একটা তালিকা তৈরি করতে পারি।

কখন, কেন আমরা রাগ করছি, কি আচরণ করছি, কি ফলাফল পাচ্ছি, এর ফলে আমাদের জীবনে কি প্রভাব পড়ছে ইত্যাদি- এরকম তালিকা তৈরি করে কিছুদিন পর খেয়াল করে দেখতে হবে, কতোটুকু ক্ষতি হচ্ছে আমাদের। আর এর পরিবর্তে পরিস্থিতিকে ইতিবাচক ভাবে নিয়ে আচরণ করলে কি প্রভাব পড়ছে নিজের আর পরিপার্শ্বের ওপর।

সব শেষে বলবো,‘বিন্দুতে হয় সিন্ধু’। যদি আমি, আপনি নেতিবাচকতা পরিহার করে চলতে পারি, তবে গোটা সমাজেই ইতিবাচক মনোভাব সবার মধ্যে আনার চেষ্টা করতে পারবো। যা মানসিকভাবে সুস্থ, কর্মোদ্যম সমাজের পাথেয় হবে।

প্রিয় পাঠক, ‘মনোকথা’ আপনাদের পাতা। মনোরোগ নিয়ে যে কোনো মতামত ও আপনার সমস্যার কথা জানাতে পারেন আমাদের। আমরা পর্যায়ক্রমে অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনাদের প্রশ্নের জবাব জানিয়ে দেবো। আপনি চাইলে গোপন রাখা হবে আপনার নাম-পরিচয় এমনি কি ঠিকানাও।

সমস্যার কথা জানানোর সঙ্গে সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ, আপনার নাম, বয়স, কোথায় থাকেন, পারিবারিক কাঠামো এবং এজন্য কোনো চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না এ বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের জানান। শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই সমস্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা জানানো সম্ভব হবে।

আপনার সমস্যা, মতামত বা পরামর্শ জানাতে আমাদের ইমেইল করুন-[email protected]

সৃজনী আহমেদ
এমডি, ফেজ এ, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বিএসএমএমইউ
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।