ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

খুলনার স্বাস্থ্যসেবা-৪

তদারকিহীন ক্লিনিক-ডায়াগনোস্টিক সেন্টার!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪
তদারকিহীন ক্লিনিক-ডায়াগনোস্টিক সেন্টার! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: সরকারি হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনার সুযোগে স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের চিকিৎসা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে।

এদিকে, সরকারি তদারকির অভাবে খুলনার ৩৩টি বেসরকারি লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারসহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠান রোগীদের দুর্বলতার সুযোগে তাদের জিম্মি করে ইচ্ছামতো অর্থ আদায় করছে।

স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার নাম করে জনসাধারণের অর্থ লুটপাট ও প্রতারণা করছে।

আর এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের অধিকাংশ চিকিৎসকই ভুয়া। সম্প্রতি ,র‌্যাব-৬ এর হাতে এ রকম সাতজন ভুয়া চিকিৎসক আটক হয়ে বর্তমানে জেলে রয়েছেন।

জানা যায়, ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের জন্য তিনজন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, ছয়জন ডিপ্লোমা নার্স, তিনজন সুইপার থাকার পাশাপাশি তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সম্মতিপত্র থাকলেই তার অনুমোদন মিলবে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। তবে অনুমোদনের আগেই এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ক্লিনিক চালু করতে হবে।

স্বাস্থ্য বিভাগের পরিদর্শন শেষে রেজিস্ট্রেশন লাভের পরেই সেটি হবে বৈধ ক্লিনিক।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র জানায়, বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে খুলনায় একশ ৬৪টি ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে ৩৩টি।

এর মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে- শেরেবাংলা রোডের আমতলা মোড়ের সেবা ক্লিনিক, ইসলামপুর রোডের খুলনা মাতৃমঙ্গল ও সেবা কেন্দ্র, গল্লামারীর খুলনা সেন্ট্রাল হসপিটাল ও আইডিয়াল নার্সিং হোম অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক, খানজাহান আলী রোডে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল (৬০ থেকে ৮০ শয্যায় উন্নীত করার পর), শান্তিধাম মোড়ের থাইরয়েড কেয়ার অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, বাবুখান রোডের মনোয়ারা হেলথ কেয়ার, ভৈরবস্ট্যান্ড রোডের ডা. মো. আমান-উল্লাহ ক্লিনিক, কেডিএ অ্যাভিনিউয়ের খুলনা সিটি হাসপাতাল (নির্মাণাধীন), হাজী মহসীন রোডের ল্যাবটেক ডায়াগনোস্টিক, আবু নাসের হাসপাতালের সামনের শেখ ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের নাহিদ ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, দৌলতপুরের ডক্টরস পয়েন্ট ডায়াগনোস্টিক কনসালটেশন সেন্টার, বয়রার খুলনা হেলথ গার্ডেন, বসুপাড়া বাঁশতলা মোড়ের এম.আর. ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, গোয়ালখালীর কমফোর্ট ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, খালিশপুর আলমনগর মোড়ের ডিজিটাল ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, সাউথ সেন্ট্রাল রোডের নার্গিস মেমোরিয়াল হাসপাতাল (প্রা.) লি., আহসান আহমেদ রোডের অঙ্কুর ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড হেলথ কেয়ার।

এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও যথাযথ নিয়ম মানছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্লিনিকগুলো যেমন সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ডিপ্লোমাধারী নার্স ও অন্যান্য চাহিদা পূরণ না করেই চলছে, তেমনি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতেও নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান; এমনকি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও।

অভিযোগ রয়েছে, লাইসেন্সধারী অনেক ক্লিনিকে চিকিৎসা দিচ্ছেন এমবিবিএস, এমডি, পিএইচডি, পিজিটি প্রভৃতি ডিগ্রি ব্যবহারকারী এসএসসি পাস ভুয়া চিকিৎসক।

মীম নার্সিং হোমের চিকিৎসক ফেরদৌস রহমান তেমনই এক চিকিৎসক; যিনি র‌্যাবের কাছে আটক হয়ে বর্তমানে জেলে রয়েছেন। এই ভুয়া চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে মৃতপ্রায় হতদরিদ্র মালেকের স্ত্রী।

কথা হয় আব্দুল মালেকের (৬০) সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ডাক্তারের পাও ধইরাও একটা টাহা কম দিতে পারি নাই। অনেক কান্নাকাটি করছি। পাষাণ ডাক্তারের মন গলে নাই। শেষমেশ গ্রামের ভিটা-বাড়ির জায়গাটুকু বন্ধক রাইখা ডাক্তারকে ১৩ হাজার টাকা পরিশোধ কইরাছি। কিনেছি হাজার হাজার টাকার ওষুধ।

তিনি জানান, তার বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার খাউলিয়া গ্রামে।

তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে আমি নগরীর মীম ক্লিনিকে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। ওই ক্লিনিকের ডাক্তার ফেরদাউস আমার স্ত্রীকে দেখে বলেন, তার জরায়ুতে টিউমার হয়েছে। অপারেশন দরকার। আমি বলি কত টাহা লাগবে? তিনি বলেন, তাকে ১৩ হাজার টাকা দিতে হবে। তারপর ডাক্তার অপারেশন করেন। কিন্তু ডাক্তার অপারেশন করলেও এখনও ব্যথা ও ঘা কমেনি।
আব্দুল মালেক জানান, তার কোনো ছেলে সন্তান নেই। একটি মাত্র মেয়ে। তিনি বর্তমানে নগরীর সাত রাস্তার মোড়ে ভিক্ষা করেন। গ্রামের বাড়ির জায়গা বন্ধক রাখার কারণে তিনি বর্তমানে নগরীর দোলখোলা আকুর বস্তিতে থাকেন।

২০ আগস্ট বুধবার মীম নার্সিং হোমের ভুয়া ওই চিকিৎসক ফেরদাউস রহমান র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেছেন।

সেই সঙ্গে একই অপরাধের দায়ে খুলনা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের ভুয়া চিকিৎসক পঞ্চানন মহলী ও  সেবা ক্লিনিকের ভুয়া চিকিৎসক অনুপ মিত্রকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো তিনমাস করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

শাহাবুদ্দিন মেমোরিয়াল ডেন্টাল ক্লিনিকের ভুয়া চিকিৎসক গাউসুল আজম, এএন ডেন্টাল কেয়ারের ভুয়া চিকিৎসক সৌমেন ও রংধুন ক্লিনিকের ভুয়া ডাক্তার ইব্রাহিম বাহাদুরকে নয় মাস করে কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো তিনমাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এছাড়া প্রাইভেট প্রাকটিস করা ভুয়া চিকিৎসক ডা. কাঞ্চিলাল বৃদ্ধ হওয়ায় তাকে একলাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

র‌্যার-৬ এর অধিনায়ক আরো জানান, অধিকাংশ ভুয়া চিকিৎসকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা তারও নিচে। দিনের পর দিন তারা প্রতারণা করে ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলেন রোগীদের।  

আটক ৩/৪ জন বিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়া না করেও এমবিবিএস বনে গেছেন। এসব ভুয়া ডাক্তারের স্বার্থ রক্ষায় একটি সংগঠনও রয়েছে বলে জানান র‌্যাব-৬ এর অধিনায়ক।   

তিনি জানান, ২০০৫ সালে ঢাকায় প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব  টেকনোলজি এবং পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সার্টিফিকেট বিক্রির কার্যক্রম চালায় প্রতিষ্ঠানটি। খুলনার ভুয়া চিকিৎসকদের বেশ কয়েকজন সেখান থেকে সার্টিফিকেট কিনেছেন।

র‌্যাবের অধিনায়ক কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল এনামুল আরিফ সুমন জানান, আটক ভুয়া চিকিৎসকরা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া না ভেবেই  রোগীদের উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকসহ পাঁচ ধরনের ওষুধ লিখে দিতেন, যা রোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকর।
খুলনার অনেক বেসরকারি ক্লিনিকের ডাক্তাররা আব্দুল মালেকের মতো রোগীদের অসহায়তাকে পুঁজি করে এভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। এতে সহায়সম্বল হারিয়ে অনেকেই হচ্ছেন নিঃস্ব।

অভিযোগ রয়েছে, নগরীর অধিকাংশ ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের নিবন্ধন নেই, অথচ তারা দেদারছে ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক অনেকেই সরকারি হাসপাতালের বড় ডাক্তার।

এসব ক্লিনিকে এত বেশি রিপ্রেজেন্টটিভ থাকেন, যার কারণে ডাক্তার দেখাতে ভেতরে প্রবেশ করাই মুশকিল হয়ে পড়ে।

সবচেয়ে বেশি যেসব ক্লিনিকের সামনে এদের দেখা যায়, সেগুলো হচ্ছে- খুলনা ক্লিনিক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, নাসির গর্ডেন, গরীব নেওয়াজ ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, সিটি ইমেজিং সেন্টার, থাইরয়েড কেয়ার অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, মনোয়ারা হেলথ কেয়ার, ডা. মো. আমান-উল্লাহ ক্লিনিক।   

এ বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মামুন পারভেজ বাংলানিউজকে বলেন, লাইসেন্সবিহীন অথবা ভুয়া যেসব চিকিৎসক মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তাদের ধরতে অচিরেই অভিযান চালানো হবে।
তিনি জানান, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে।
 
তিনি আরো বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা দেওয়া আছে। স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতর থেকে ভিজিট করে সব শর্ত পূরণ হলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাইসেন্স দেওয়া হবে।

** উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবায় ধস
** রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি খুমেক হাসপাতালে!
** গণভোগান্তির অপর নাম জেনারেল হাসপাতাল

বাংলাদশে সময়: ১০৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।