গোপালগঞ্জ: চরম অবস্থাপনা ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা কার্যক্রম।
নিয়মানুযায়ী বিনামূল্যে ও নির্ধারিত মূল্যে স্বাস্থ্যসেবাসহ যেকোনো সেবা পাওয়ার কথা থাকলেও এখানে তা রীতিমতো অমাবস্যার চাঁদ।
এমনকি ছুটকো কোনো কাজের জন্যেও এখানে পদে পদে টাকা দিতে হয়। সেবা ও ব্যবস্থাপনায় এ উপজেলা কমপ্লেক্সের এমনই বেহাল দশা, যেন অনিয়মই এখানে অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার ওপর ৫০ শয্যার উপজেলার এ হাসপাতালটির কার্যক্রম এখনো পুরোদমে চালু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। নেই পর্যাপ্ত জনবল। ফলে যেটুকু সেবা পাওয়া সম্ভব তাও পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।
অসুস্থকে সুস্থ করে তোলার জন্য এ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা হলেও এর অভ্যন্তরে যত্রতত্রভাবে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখায় প্রচণ্ড দুর্গন্ধ হাসপাতাল জুড়ে। এতে দীর্ঘ সময় কেউ এখানে অবস্থান করলে কোনো সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।
অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে রয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট। সেই সঙ্গে কর্মচারীদের নানা স্বেচ্ছাচারিতা যোগ হয়ে রোগীদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ।
এছাড়া ৫০ শয্যার এ হাসপাতালের পুরাতন ভবনের অবস্থা জীর্ণ। এর ছাদের বিভিন্ন অংশে পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। এর ওপর অভিযোগ রয়েছে সন্ধ্যার পর এটি চলে যায় মাদকসেবীদের দখলে।
সম্প্রতি সরেজমিনে কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
১৯৭২ সালে কোটালীপাড়ায় ৩১ শয্যাবিশিষ্ট এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি স্থাপিত হয়। ২০১০ সালে এটিকে ৫০ শয্যায় রূপান্তর করা হয়। কিন্তু এখনো ৫০ শয্যার লোকবল নিয়োগ হয়নি। এ হাসপাতাল থেকে উপজেলায় বসবাসরত ১২ ইউনিয়নের ৩ লক্ষাধিক মানুষ ও আশপাশের এলাকাসহ মোট ৪ লক্ষাধিক লোকের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।
হাসপাতালটিতে আউটডোরে চিকিৎসা সেবা নিতে ৫ টাকার টিকিটের ব্যবস্থা সরকারিভাবে রয়েছে। কিন্তু এখানে নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে এজন্য দিতে হয় ১০ টাকা।
প্রসূতি মায়েদের সেবাসহ নিরাপদ প্রসবের জন্য অতিরিক্ত কোনো অর্থ আদায় অনৈতিক হলেও এখানে নিরাপদ প্রসবের জন্য নার্সদের দিতে হয় ৩শ থেকে ৫শ টাকা। কিন্তু নিয়মমাফিক এখানে জন্মের পর শিশুকে শাল-দুধ ও প্রসুতি মাকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয় না।
সরকার নির্ধারিত মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা থাকলেও এখানে এমআর (মিনিস্ট্রেশন রেগুলেশন) বা ডিএনসি (ডিলেশন কিউরেট) করাতে দিতে হয় দেড় থেকে ২ হাজার টাকা। সরকারি সেবার বিনিময়ে জোরপূর্বক অতিরিক্ত অর্থ আদায় এখানে ওপেন সিক্রেট।
তবে এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক-নার্স কিংবা কর্মকর্তারা সেবার বিনিময়ে টাকা নেওয়াকে অপরাধ মানতে নারাজ। তারা মনে করেন এটা তাদের প্রাপ্য।
কোটালীপাড়া সদরের ফেরধারা গ্রামের দীপক মধু জানান, তার স্ত্রী সীমাকে নিরাপদ প্রসবের জন্য জরুরি প্রসুতি বিভাগে ভর্তি করান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে নিরাপদ প্রসবের জন্য কর্মরত নার্সরা একটা স্লিপ ধরিয়ে দেন। রাত ৩টার দিকে প্রসব ব্যথা উঠলে নার্স আবারো ওষুধ আনতে পাঠান। গভীর রাতে তার সন্তানের জন্ম হয়। এ সময় তার স্ত্রী প্রচুর রক্তক্ষরণ হলেও কোনো চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন না। তবে দুই নার্সকে ৮শ টাকা দিতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে দায়িত্বরত নার্স উষা বৈষ্ণব জানান, রোগীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়া হয় না। নার্সরা কষ্ট করেন, তাই তারা খুশি হয়ে টাকা দেয়। এটিকে তিনি অনৈতিক বলতে রাজি নন। আর বিষয়টি কর্তৃপক্ষ জানেন বলেও জানান।
এদিকে, হাসপাতালে ঠিকমতো সেবা না দিয়ে এখানে কর্মরত চিকিৎসকরা হাসপাতালের বাইরে ও বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে সময় দিতে বেশী উৎসাহী। প্রায় সব চিকিৎসকই বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখেন ও অপারেশন করেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে অপারেশনের পর রোগীকে এ হাসপাতালে ভর্তি করে সেবা দেওয়া হয়।
রামশীল গ্রামের মাখন সমাদ্দার (৮৫), বাহের শিমুল গ্রামের কায়ুম শেখ (৩৫), সিতাই কুন্ডু গ্রামের রেজাউল সিকদার (৩০) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বেশ কয়েকদিন। তারা অভিযোগ করেন, তাদের হাসপাতাল থেকে কোনো ওষুধই দেওয়া হয়নি। তারা বাইরে থেকে সব ওষুধ কিনছেন।
আরো অভিযোগ রয়েছে, এখানে পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন দামী ও উন্নত প্রযুক্তির মেশিন ও যন্ত্রপাতি থাকলে তা সব ব্যবহার করা হয়। এমনকি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করাতেও রোগীদের বাইরে পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে প্যাথলজিস্ট কনিকা রানী বিশ্বাস বলেন, টেস্ট করার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি ও মেডেসিন থাকার কথা তা হাসপাতালে না থাকায় তিনি সব পরীক্ষা করতে পারছেন না।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা বেশ কযেকজন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে ময়লা ও আবর্জনার দুর্গন্ধে থাকা কষ্টকর। বিভিন্ন স্থানে ছাদের পলেস্তারা অনেক সময় ভেঙে শরীরের ওপর পড়ে। তাই থাকতেও তাদের ভয় হয়।
বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. প্রেমানন্দ মন্ডল নার্সদের টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, আমি কাউকে টাকা নেওয়ার অনুমতি দেয়নি। তবে কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে অনেকে তা নিয়ে থাকেন।
হাসপাতালের চরম অবস্থাপনা ও অনিয়মের ব্যাপারে কথা হলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. পবিত্র কুমার কুন্ডু বলেন, অতিসম্প্রতি আমি কোটালীপাড়ায় যোগদান করেছি। আমি বিভিন্ন অনিয়ম দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যদি কারো অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়ে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।
হাসপাতালের পরিস্কার-পরিছন্নের বিষয়ে বলেন, ইনডোর ও আউটডোরের জন্য ৪ জন সুইপার নিয়োজিত রয়েছেন। ৪ জন দিয়ে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল পরিস্কার-পরিছন্ন রাখা সম্ভব না।
চলমান সব অনিয়ম যত দ্রুত সম্ভব ঠিক করে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৪