বর্তমানে দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য বিশ্বের ১৪৮টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই খাতের সম্ভাবনা ও নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইলিয়াছ মৃধা।
বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পের সম্ভাবনা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। এটি অনেকটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খরচ বেড়ে যায়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে কৃষিকাজ করে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহযোগিতা এবং বেকার ও নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে অবশ্যই কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের দিকে নজর দিতে হবে।
এই শিল্পের স্থানীয় বাজার বড় করতে পারলেই রপ্তানি বাজার বড় হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই খাতে রপ্তানি আয়ে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে?
বিশ্ববাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরে অনেক ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের পড়তে হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতি, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক আরোপে রপ্তানি বাণিজ্য হোঁচট খেয়েছে। এর পরও আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
আমরা নতুন নতুন বাজার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিটিকে টার্গেট করেই পণ্য রপ্তানি করব। আমরা সেভাবেই পণ্যের ডিজাইন, প্রাইসিং, গুণগত মান উন্নত করার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, যাতে আমরা মূলধারার বাজারে প্রবেশ করতে পারি। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।
প্রাণ গ্রুপ বর্তমানে কতটি দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করছে?
বর্তমানে আমরা ১৪৮টি দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করছি। বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করছি। আগে ভারতে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হতো।
আন্তর্জাতিক বাজারে গুণগত মান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণ কী ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করে?
রপ্তানি করতে হলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদন করতে হবে। তাই বিশ্বের সর্বশেষ প্রযুক্তির সরঞ্জাম আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসছি।
বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ লোকজন এনে আমাদের কর্মীদের দক্ষ করছি, যেন আমরা আন্তর্জাতিক মানের পণ্য রপ্তানি করতে পারি।
বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?
আমাদের দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করলে ১২০ দিনের মধ্যে ফরেন কারেন্সি আনতে হয়, এখন দেখা যাচ্ছে একটি পণ্য উৎপাদন করে যখন রপ্তানি করছি সে দেশে পৌঁছাতেই আড়াই থেকে তিন মাস চলে যাচ্ছে। সাধারণত সে দেশে যাওয়ার পর রপ্তানিকারক পণ্য বিক্রি করে টাকা দেবে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকাটি আসছে না। ফলে এখানে ‘ওভারডিউ’ হয়ে যাচ্ছে আড়াই থেকে তিন মাস। আমি সরকারকে বলব, ১২০ দিনের পরিবর্তে অন্তত ১৮০ দিন যাতে বিবেচনা করা হয়।
রপ্তানি উপযোগী প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরিতে মান নিয়ন্ত্রণ ও সার্টিফিকেশন নিয়ে কী ধরনের জটিলতা আছে?
আমাদের দেশে সার্টিফিকেশন সংস্থা নেই, ফলে আমাদের বিদেশি কনসালট্যান্ট বা বিদেশি এজেন্সির ওপর নির্ভর করতে হয়। এটি আমাদের জন্য ব্যয়বহুল। যদি সরকারের কোনো সংস্থার মাধ্যমে এই ফ্যাসিলিটিগুলো দেওয়া হতো তাহলে আমরা খুবই কম খরচে এগুলো নিতে পারতাম।
সরকার কী ধরনের সহায়তা দিচ্ছে এই খাতকে এগিয়ে নিতে?
সরকার প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি খাতের জন্য আলাদা করে কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। রপ্তানিতে আগে নগদ সহায়তা ছিল ২০ শতাংশ, সেটি নামিয়ে এখন ১০ শতাংশে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া আমাদের প্রণোদনা হিসেবে বছরে সম্মানসূচক রপ্তানি ট্রফি দেওয়া হয়। এটি পেয়ে আমরা অনুপ্রাণিত হই। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি মেলার আয়োজন করছে। এসব মেলায় আমরাও অংশগ্রহণ করছি। এতে দেশের পণ্যের প্রচার ও প্রসার ঘটছে। নতুন নতুন বাজার উন্মোচন করতে সক্ষম হচ্ছি।
এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার?
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভ্যাট-ট্যাক্স সুবিধা ও নিরবচ্ছিন্ন পানি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এখন আমরা যখন নতুন প্রজেক্ট করতে যাচ্ছি তারা আমাদের বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত ঋণ সহায়তা দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। তাই আমাদের দেশে অতিদ্রুত রাজনৈতিক সরকার আসা উচিত।
বাংলাদেশ কি কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বড় কোনো মাইলফলক ছুঁতে পারবে?
এরই মধ্যে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। যদিও তা পোশাক খাতের তুলনায় খুবই অল্প। এই খাতকে উৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে যদি সহযোগিতা করা হয় তাহলে আগামী কয়েক বছরেই এই খাতের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।
ভবিষ্যতে প্রাণ গ্রুপের রপ্তানি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা কী?
আমরা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পণ্য যুক্ত করছি। আমরা আগামী দিনগুলোকে লক্ষ্য করে বিশ্বমানের কনফেকশনারি পণ্য, বিস্কুট ইত্যাদি উৎপাদন করছি। এগুলোর রপ্তানির বাজার প্রচুর উন্মুক্ত। আমরা যদি এখানে আরো কাজ করি তাহলে রপ্তানির দ্বার আরো উন্মোচিত হবে। আমাদের রপ্তানির হার আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৪-১৫ শতাংশে উঠে গেছে। পাশের দেশে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট। আসিয়ান দেশগুলোতে সুদের হার মাত্র ৪-৫ শতাংশ। ফলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় যদি টিকে থাকতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে রাখতে হবে।
সৌজন্যে কালের কণ্ঠ