ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

স্থানীয় জাতের বিলুপ্তি রোধে অল্পনার বীজ ভাণ্ডার

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৩ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০২৪
স্থানীয় জাতের বিলুপ্তি রোধে অল্পনার বীজ ভাণ্ডার

সাতক্ষীরা: অল্পনা রানি মিস্ত্রি। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট গ্রামের এ কৃষাণি নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন স্থানীয় জাতের শাক-সবজি, ঔষধি ও ফলের গাছের বীজ ভাণ্ডার।

তার বীজ ভাণ্ডার রয়েছে অচাষকৃত কিন্তু পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নানা উদ্ভিদের বীজও। ২২ ধরনের শিম, আট ধরনের ডাঁটাশাক, ১০ ধরনের মরিচ, শতাধিক ঔষধি, ৫০-৬০ ধরনের সবজি, ২২ ধরনের অচাষকৃত উদ্ভিদসহ তার সংগ্রহে চার শতাধিক ধরনের বীজ রয়েছে।  

অল্পনা রানির বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায় বীজ রাখার ঘর, যেখানে বয়ামে, প্যাকেটে বা বস্তায় রাখা হয়েছে বীজ। এসব বীজ দিয়েই চাষাবাদ করেন অল্পনা রানি, বিতরণ করেন গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের মাঝেও।

অল্পনা রানির মতে, স্থানীয় জাতের বীজ চাষাবাদে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে না। এ বীজ থেকে উৎপাদিত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করা যায়। জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা যায় বলে মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।

তিনি স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ না করলে কৃষককে কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যেতে হবে।

এজন্য স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে সাধারণ কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন তিনি।

স্থানীয় বীজ সংরক্ষণে কীভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন জানতে চাইলে অল্পনা রানি বলেন, আগে দুই-একটি বীজ রাখতাম। ২০১২ সালে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) আমাকে বীজ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে এর গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝায়। প্রশিক্ষণও দেয়। নানাভাবে সহায়তাও করে। বারসিকের উৎসাহ পেয়েই আমি বীজ সংরক্ষণ শুরু করি। যা এক যুগের ব্যবধানে বীজ ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, হাইব্রিড বীজ কিনে কৃষকরা প্রতিনিয়ত ঠকছে। হাইব্রিড বীজ চাষ করতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে, হাইব্রিড বীজের ফসল থেকে বীজ রাখাও যায় না। এখন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে উৎপাদিত ফসল খেয়ে মানুষের নানা রকম রোগ বালাই হচ্ছে। আর বীজ রাখতে না পারায় কৃষক কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে।


বিপরীতে স্থানীয় জাতের বীজ চাষ করতে কোনো রকম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে না। জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেই ফসল উৎপাদন করা যায়, এর বীজও রাখা যায়, মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে- যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের মাধ্যমেই কৃষক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। এর মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদাও নিশ্চিত করা সম্ভব। এজন্য কোনো বীজই আমি হারিয়ে যেতে দিই না।

অল্পনা রানির মতে, উপকূলীয় দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় বীজ সংরক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর শ্যামনগর উপকূলে অন্তত দুটি করে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। এতে অনেক সময় বপন করা বীজ নষ্ট হয়ে যায়। অনেক বীজ হারিয়ে যায়। এমন সময় কৃষকের হাতে বীজ থাকলে আবার বুনতে পারবে। কিন্তু বীজ না থাকলে আবার কেনা ছাড়া উপায় থাকে না।

কীটনাশকের বদলে ফসলের ক্ষেতে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিমপাতা ও মেহগনির ফল দিয়ে বালাইনাশক তৈরি করি। এছাড়া সহনীয় মাত্রায় ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানি স্প্রে বা ঘুটের ছাই কিংবা তুঁতে ও চুন দিয়ে বৈদ্য মিশ্রণ তৈরি করে ক্ষেতে ব্যবহার করি। বালাইনাশক হিসেবে এগুলো খুবই উপকারী।  

বীজ সংরক্ষণ ও স্থায়িতশীল কৃষি চর্চার জন্য তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। এজন্য বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ভোলেননি স্বশিক্ষিত কৃষাণি ও ‘খাদ্যযোদ্ধা’ অল্পনা রানি।

তিনি বলেন, নদী পার হতে গেলে যেমন সাকো লাগে, বারসিক আমার জীবনে সেই সাকো হিসেবে কাজ করেছে। আমার জীবনে আলো দিয়েছে। জ্ঞানের আলো। যদি তারা আমাকে কোনো অনুদান দিত, হয়তো তা খেয়ে ফেলতাম। কিন্তু তারা তা না দিয়ে আমাকে দিয়েছে জ্ঞানের আলো। এ জ্ঞানের আলোয় আমার জীবন ভরে উঠেছে। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এছাড়া আমি ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক, ২০২০ সালে অন্যান্য পুরস্কার, উপজেলা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে জয়িতা পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার পেয়েছি। দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যম আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে আসে। আমার জীবনে আর কী চাওয়া আছে?

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০২৪
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।