ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৯ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭
সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি ছবি: বাংলানিউজ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ফিরে: কথায় আছে নিরাপদ খাদ্যই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য। খাদ্যের নিরাপত্তা ঠিক থাকলে দাম কোনো সমস্যা নয়। আর উৎপাদনের শুরু থেকেই যদি নেওয়া হয় নিরাপদ ব্যবস্থা তাহলে তো ভাবনার অবকাশই নেই। এ সূত্রগুলোই এখন নিয়ামক হয়ে উঠেছে আমের ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতির।

একেবারেই নতুন ধারণা নিয়ে ‘ম্যাংগো ক্যাপিটাল’ খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে অভিনব এ পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয় ২০১৫ সালে। যার আকাশচুম্বী সফলতা আসে মাত্র এক বছরেই।

প্রতিকূলতার মই বেয়ে পরীক্ষার দেয়াল পেরোয় ২০১৬ সালে। এরপর থেকে নতুন পদ্ধতিতে তরতর করে বাড়ছে আমচাষ। ফ্রুট ব্যাগিং করা আম স্বাদ ও গুণে থাকছে অটুট। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ আম এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে সুদূর ইউরোপের দেশগুলোতে। ফলে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি এ অঞ্চলের আমচাষিদের জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন।
 
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের আতাহির গ্রামের আমচাষি কফিল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ফলন ও দাম  ভালো পাওয়ায় গত বছর থেকে বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতিতে আম চাষ শুরু করেন জেলার আমচাষিরা। নতুন পদ্ধতি ব্যবহারে কীটনাশকের খরচও অনেক কমেছে। ধীরে ধীরে  ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি এ অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই চাহিদাও বেড়েছে বলে জানান কফিল উদ্দিন।

এক প্রশ্নের জবাবে সফল এ চাষি বলেন, ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে এ পদ্ধতিতে চাষ করা আম বিষমুক্ত। তাই গত দুই বছরে ইউরোপের দেশগুলোতে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ করা আমের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ। এতে চলতি বছর এ ব্যাগের ব্যবহারও কয়েকগুণ বেড়েছে বলে জানান কফিল। সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি

আতিহার গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সারি সারি আম বাগান। গাছে গাছে ঝুলছে আম। আদর-যত্নে সেই আম ঢেকে রাখা হয়েছে বিশেষায়িত এ ব্যাগের ভেতরে। চীন থেকে আসা হলুদ রঙের এ ব্যাগ দিয়ে গাছের প্রতিটি আমই মোড়ানো। সড়ক পেরিয়ে যেতে বেশক’টি বাগানে একইদৃশ্য চোখে পড়ে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আতাহির ও মহারাজপুরের পর জেলার শিবগঞ্জেই বেশি আম চাষ হচ্ছে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতিতে। শিবগঞ্জ উপজেলার সদর পৌরসভার মধ্যে চক দৌলতপুর, সেলিমাবাদ, দেবীনগর। এর বাইরে কানসাট, মনাকষা, চককীত্তিসহ বিভিন্ন এলাকায়ও নতুন পদ্ধতিতে আম চাষ হচ্ছে।  

পদ্ধতি সম্পর্কে শিবগঞ্জের আম ব্যবসায়ী শামীম হোসেন বাংলানিউজকে জানান, সাধারণত ব্যাগিং করার উপযুক্ত হচ্ছে ৩৫-৪০ দিন বয়সের আম। তবে এরপরেও ব্যাগিং করা যায়। এছাড়া ব্যাগিং করার আগেই মরা মুকুল বা পুষ্পমঞ্জুরির অংশবিশেষ, পত্র, উপপত্র ছিঁড়ে ফেলতে হয় এবং কাজটি করার সময় আমটি ব্যাগের মাঝ বরাবর রাখতে হবে। আর ব্যাগের শীর্ষ প্রান্ত এমনভাবে মুড়িয়ে দিতে হবে যেন পানি বা অন্যকিছু ভেতরে না ঢুকতে পারে। ‘ফল’ গাছে থাকা অবস্থায় বিশেষ এ ব্যাগ দিয়ে আবৃত করাকেই ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি বলে। ২০১৫ সালে চাঁপাইনববগঞ্জেই পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

এর উদ্দেশ্য আমকে বিষমুক্ত এবং রোগবালাই, বাইরের প্রখর সূর্যালোক ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। ফ্রুট ব্যাগিং করা আম দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। এ পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে আম সংরক্ষণ করতে ফরমালিন নামক বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রয়োজন হয় না। আর নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাগিং করা গেলে কোনো স্প্রে ছাড়াই ক্ষতিকর পোকার হাত থেকে আম রক্ষা করা সম্ভব। ২০১৬ সাল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাণিজ্যিকভিত্তিতে আম চাষে শুরু হয়েছে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতির ব্যবহার।

বর্তমানে চীন থেকে সরাসরি এ বিশেষ ব্যাগ আমদানি হচ্ছে। আবার জেলায় গড়ে ওঠা ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানও স্থানীয়ভাবে ব্যাগ তৈরি করছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান জেসমিন আক্তার বাংলানিউজকে জানান, তারা চীন থেকে কাগজ কিনে আনছেন। পরে তাদের ফ্যাক্টরিতে ব্যাগ তৈরি করছেন। একটি ব্যাগ ৩ টাকা ৩০ পয়সা খরচ পড়ছে। কেউ বাইরের জেলায় নিতে চাইলে সাড়ে ৩ টাকা করে পড়বে।

এদিকে চাঁপাইনবাগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মঞ্জুরুল হুদা বাংলানিউজকে জনান, জেলায় গত বছর ৩০ লাখ ব্যাগ ব্যবহার হলেও এবছর দেড় কোটি ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। এখনও ফজলি এবং আশ্বিনা আমে ব্যাগ পড়ানো হয়নি। তবে আরও ১৫ দিন সময় তাদের হাতে রয়েছে।

মঞ্জুরুল হুদা বলেন, এ দেড় কোটি ব্যাগ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন আম পাওয়া যাবে। তাই চলতি বছর একই পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হবে। ২০১৫ সালে জেলা থেকে আম রপ্তানি হয় মাত্র সাড়ে ৩ মেট্রিক টন, যা ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছিল ১শ’ ১০ মেট্রিক টনে।

ফ্রুট ব্যাগিংয়ে একদিনে বিপ্লব আসেনি। এজন্য অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। আমচাষিদের নিয়ে সভা করা হয়েছে। বিষয়টি বোঝার পর চাষিরা ঝুঁকি নিয়েই এ পদ্ধতিতে চাষ করেছেন। সফলতা আসায় তাদের দেখাদেখি নতুনরাও এ পদ্ধতি অবলম্বন করছেন বলে জানান ঊর্ধ্বতন এ কৃষি কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭
এসএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।