ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

কৃষি

‘বিষাক্ত’ আনারসের দখলে মধুপুরের বাজার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৮
‘বিষাক্ত’ আনারসের দখলে মধুপুরের বাজার সুদৃশ্য আনারস। ছবি: বাংলানিউজ

টাঙ্গাইল: ‘বিষাক্ত’ আনারস দখল করে নিয়েছে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী মধুপুরের পঁচিশমাইল জলছত্র আনারসের হাট।এখানকার আনারসের দেশজোড়া খ্যাতি থাকলেও কেমিক্যালের ব্যবহারে দিনদিন এ হাট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

তাদের অভিযোগ, বর্তমানে সাধারণ মানুষ বিষমুক্ত ফল খেতে চান। তারপরও আনারস চাষিরা বেশি লাভের আশায় ফলে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করছেন।

সাধারণত রোপণের ১৫ থেকে ১৬ মাস পর আনারস সংগ্রহ করা যায়। স্বাভাবিকভাবে আনারস কিছুটা বড় হওয়ার ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিপূণ আকৃতি পায় এবং পাকে। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু চাষি বেশি লাভের আশায় আনারস একটু বড় হলেই তাতে ইথোফন বা রাইপেন নামক রাসায়নিক স্প্রে করে। এতে মাত্র তিন থেকে চারদিনেই আনারস পরিপূণ আকৃতি পেয়ে পেকে যায়। শুধু কি ইথোফন/রাইপেন? স্থানীয় অনেকে বলছেন, রাইপেন/ইথোফনের সঙ্গে আনারসে স্প্রে করা হয় পটাশ, ফরমালিন, শ্যাম্পু, সিঁদুর, স্প্রিরিটসহ বিভিন্ন রাসায়নিক। এতে দ্রুত পাকার পাশাপাশি দেখতেও হয় আকর্ষণীয়। স্বাভাবিকভাবে পাকা ফলের তুলনায় এসব ‘বিষ’যুক্ত ফল পচে দেরিতে। এতে চাষি আর্থিকভাবে লাভবান হলেও ইথোফন ও অন্যান্য রাসায়নিকের বিরূপ প্রভাব পড়ে মানবদেহে। তাই জনগণ এখন কোনো ধরনের রাসায়নিকযুক্ত ফল খেতে চান না। ফলে ‘বিষ’যুক্ত এসব আনারস কিনে বাজারে বিক্রি করতে অনেকটাই হিমসিম খেতে হচ্ছে পাইকারদের। লাভ তো দূরের কথা মূলধন ওঠানোই কঠিন হয়ে পড়ছে।
চাষিরা সাইকেলে করে বাজারে আনারস নিয়ে যাচ্ছেন।  ছবি: বাংলানিউজ

মধপুর বনাঞ্চলের আলোকদিয়া, আউসনারা, দিগর বাইদ, অরণখোলা, জলছত্র, মোটের বাজার, গারো বাজার, রসুলপুর, পঁচিশমাইল, ইদিলপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, আনারসের জমিতে কর্মব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা। সূর্য ওঠার আগেই জমি থেকে আনারস কেটে ঝুড়ি ভর্তি করে ভ্যান, রিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে বাজারে নিয়ে আসছেন বিক্রির জন্য। মধুপুরের আনারস স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় ঢাকা, কুমিল্লা, পাবনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আনারস কেনার জন্য আসা ব্যাপারীরা  ভিড় করেছেন পঁচিশমাইল জলছত্র আনারসের বাজারে। চাষিরা আনারস বিক্রি করে সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু পাইকাররা আনারস কিনে অনেক ক্ষেত্রেই পড়ছেন বিপাকে। জনমনে রাসায়নিক আতঙ্ক থাকায় সেই আনারস বিক্রি করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের।

যতোই দিন যাচ্ছে ততোই কমছে এখানকার আনারসের চাহিদা। আগের তুলনায় উৎপাদন বাড়লেও নেই আগের মতো স্বাদ আর গন্ধ। আনারস চাষিদের ওষুধ প্রয়োগের ওপর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। অনেকেই কিছু ওষুধ বিক্রেতার কু-পরামর্শে নানা ধরনের রাসায়নিক প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রুত আনারস পাকিয়ে ফেলছেন। ফলে আনারস দেখতে সুন্দর হলেও এর স্বাদ গন্ধ কোনোটাই পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে মানুষ আনারস কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আনারসের বাম্পার ফলনে চাষিদের আনন্দিত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তব তার উল্টো। যেখানে প্রতিটি আনারসের মূল্য থাকার কথা ছিল ৫০/৬০ টাকা, সেখানে চাহিদা কম থাকায় প্রতিটি আনারস বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১০/১৫ টাকায়।

আনারস ফুল।  ছবি: বাংলানিউজ

গারোবাজারের কৃষক আনছের আলী মিয়া জানান, ৭০ বিঘা জমিতে এবার তিনি আনারস চাষ করেছেন। প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচশ’ আনারস বাজারে বিক্রি করছেন।  

রাসায়নিক দেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আনারসে রাসায়নিক না দিলে প্রতিদিন হয়তো এক থেকে দুইশ’ আনারস বাজারে বিক্রি করতে পারতাম। রাসায়নিক দিলে দ্রুত পাকে। তাই আনারসে রাসায়নিক দিতে হয়।

আনারসের হাট।  ছবি: বাংলানিউজ

মহিষমাড়া গ্রামের খন্দকার মোতালেব হোসেন জানান, ‘বিষ’মুক্ত আনারস আকারে অনেক ছোট। আর এর রঙ দেখে ক্রেতারা কিনতে চায় না। এ আনারস বাগান থেকে কেটে দুই-তিনদিনের বেশি রাখা যায় না, পচে যায়। কিন্তু ফরমালিনযুক্ত আনারস সাত/আটদিন রাখা যায়। আর অন্যান্য রাসায়নিক দিলে আনারসের আকারও অনেক বড় হয়, আবার রং গাঢ় হলুদ হয়। ফলে সহজেই সাধারণ ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়। এতে ক্রেতা বা বিক্রেতাদের কোনো অসুবিধা হয় না। লাভও অনেক বেশি। তাই বাধ্য হয়েই বেশিরভাগ চাষি আনারসে ফরমালিন ও ইথোফন স্প্রে করেন।

ক্ষেত্রে আনারস।  ছবি: বাংলানিউজ

নাটোর থেকে আসা বেপারী আহসান হাবিব জানান, তিনি প্রতিবছর মধুপুর আসেন আনারস কিনতে। এবারও এসেছেন। কিন্তু আগের তুলনায় এবার বাজারে আনারসের চাহিদা অনেক কম। এর কারণ ব্যখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা এখন আর ‘বিষ’যুক্ত কোনো ফলই খেতে চায় না। রাসায়নিকযুক্ত একটি বড় আনারস ১২ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করতে পারছেন কৃষকরা। রাসায়নিকমুক্ত আনারস আকারে ছোট এবং রংও তেমন ভালো না হলেও খেতে খুব সুস্বাদু। সাধরণ মানুষ আকারে ছোট ও দেখতে ভালো না হওয়ায় এগুলো কিনতে চায় না। দেখতে ভালো না হওয়ায় দামও খুব কম, প্রতিটি ‘বিষ’মুক্ত আনারস চার থেকে আট টাকায় বিক্রি করেন কৃষক। তাই বাধ্য হয়েই চাষিরা ‘বিষ’যুক্ত আনারসই বিক্রি বা চাষ করছেন।

চাষিরা সাইকেলে করে বাজারে আনারস নিয়ে যাচ্ছেন।  ছবি: বাংলানিউজ

মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুক্কাদির আজিজ বাংলানিউজকে জানান, আনারসে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ বন্ধে ব্যাপক প্রচারণা এবং কৃষি সমাবেশ করা হয়েছে, হচ্ছে। এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বাংলানিউজকে জানান, এ বছর টাঙ্গাইলের নয় হাজার হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিকটন।

তিনি আরো বলেন, আনারসের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। পরিমাণ মতো রাসায়নিক প্রয়োগ করলে মানবদেহের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু না জেনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করলে তা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪১ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৮
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।