ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

কৃষি

লাভের মুখ দেখায় ‘টার্কি’ পালনে ঝুঁকছে খামারিরা

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৮
লাভের মুখ দেখায় ‘টার্কি’ পালনে ঝুঁকছে খামারিরা টার্কি-ছবি-বাংলানিউজ

ফেনী: ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের গাবতলা গ্রামের বাসিন্দা একরামুল হক একরাম। ব্রয়লার মুরগির খামারি ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন এ মুরগি লালন-পালন করে লাভের মুখ না দেখায় সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে আগ্রহী হোন টার্কি পালনে। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে আয়ারল্যান্ডস্থ প্রবাসী মামা সলিম উল্লাহ মজুমদারের পরামর্শে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেন টার্কি লালন-পালন। 

ওই বছরের শুরুতে ৬৩টি বাচ্চা টার্কি নিয়ে একরাম শুরু করেন খামার। প্রথম দফায় মাত্র ১০টি বাচ্চা ছাড়া সবগুলো মারা গিয়েছিল, কিন্তু একরাম হাল ছাড়েননি।

যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষক নুরুল আমিনের পরামর্শে ১শ’ ডিম থেকে ৫০টি বাচ্চা ফুটিয়ে খামার চালিয়ে নিলেন। সেই থেকে একরামকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তিন মাস পর থেকেই আসতে শুরু করে আয়।

খামারে বাচ্চা টার্কির পরিচর‌্যা করছেন খামারি একরামুল হক একরাম-ছবি-বাংলানিউজএকরাম বলেন, খামারের ঘর, ডিম ফোটানোর ইনকিউভেটর, বাচ্চা সব মিলিয়ে ৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ তার। এখন প্রতি মাসে সেখান থেকে আয় হয় ৪০ হাজারেরও বেশি। এখন তার খামারে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন শতাধিক টার্কি পাখি রয়েছে। প্রতি মাসে ডিম থেকে ফোটে ২৫০টির মতো বাচ্চা। তাকে দেখে গ্রামের আরও অনেকে বাণিজ্যিক এবং ব্যক্তিগতভাবে টার্কি পালন শুরু করেছেন।  

টার্কি পালনে সফলতার এমন গল্প শুধু একরামের নয়। এমন আরও অনেকেই আছেন যারা টার্কি পালন করে রাতারাতি তাদের জীবন বদলাতে পেরেছেন। পরশুরাম উপজেলার বাঁশপদুয়া গ্রামের আজমীর হোসেন জুয়েল তাদের মধ্যে অন্যতম। ‘আল্লাহর দান টার্কি খামার’ নামের তার খামারটি জেলায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠে। তিনিই মূলত পথ দেখান অন্য খামারিদের।  

২০১৩ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে খামারটি। টার্কি বিক্রি ও বাচ্চা উৎপাদন করে কোটিপতি হয়ে গেছেন খামারের মালিক আজমীর হোসেন জুয়েল। ১৬ শতক জায়গার উপর ‘আল্লাহর দান টার্কি ফার্ম’ নামে টার্কি খামার গড়ে তোলেন ফিস ও ফিডস ব্যবসায়ী জুয়েল। প্রথমে আমেরিকা থেকে ২শ’ বাচ্চা এনে খামার শুরু করেন তিনি। বর্তমানে তার তিনটি খামারে প্রায় ৬ শতাধিক টার্কি রয়েছে।  টার্কি পালন করে কোটিপতি হয়েছেন ব্যবসায়ী জুয়েল-ছবি-বাংলানিউজজুয়েল জানান, একটি টার্কি একটানা ২২টি পর্যন্ত ডিম দেয়। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করা হ্যাচারি মেশিনে ডিম রাখার ২৮ দিন পর বাচ্চা ফোটে। দানাদার খাদ্য ছাড়াও কলমি শাক, বাঁধা কপি ও সবজি জাতীয় খাবার খায় টার্কি। ৪ মাস পর থেকে খাওয়ার উপযোগী হয় টার্কি। ৬ মাসের মুরগি প্রায় ৬/৭ কেজি পর্যন্ত হয়। দেড়-দুই বছর লালন-পালন করলে একটি টার্কির ওজন প্রায় ২৪ কেজি পর্যন্ত হয়। প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হয় ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা হিসেবে। এক মাস বয়সী বাচ্চা বিক্রি হয় জোড়া সাড়ে ৪ হাজার টাকায়।  

তিনি জানান, এ খামার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ বাচ্চা নিয়ে গেছে। রপ্তানি করা হচ্ছে বিদেশেও। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন, পুরো জেলায় এখন ৩৯টি খামারে প্রায় ৪ হাজার টার্কি পাখি রয়েছে।

পোল্ট্রি কনসালটেন্টের মতে ‘টার্কি’
টার্কির ব্যাপারে কথা হয় ফুলগাজী উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এইচ কমল মজুমদারের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৭শ’ সালে যুক্তরাজ্য ক্রস ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে টার্কির জাত উৎপাদন করা হয়। পোল্ট্রির ১১টি প্রজাতির মধ্যে টার্কি অন্যতম। এটি এক ধরনের বড় আকৃতির পাখি বিশেষ। এগুলো দেখতে মুরগির বাচ্চার মতো হলেও আকারে তুলনামূলকভাবে অনেক বড়। বিশ্বের সর্বত্র টার্কি গৃহপালিত পাখি হিসেবে লালন-পালন করা হয়। পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে এবং পালনের জন্য উন্নত অবকাঠামো দরকার হয় না। টার্কি প্রতিদিন মোট খাদ্যের ৩০-৪০ ভাগ নরম ঘাস খায়, তাই খাবার খরচ কম। রোগবালাই কম বলে চিকিৎসা খরচ কম। পাখির মাংস হিসেবে এটা মজাদার এবং কম চর্বিযুক্ত। তাই গরু, খাসি, পোল্ট্রি ও দেশীয় হাঁস-মুরগির মাংসের পরিপূরক হতে পারে টার্কি। ইউরোপসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই টার্কি পালন করা হচ্ছে। অনেকটা খাসির মাংসের মতই টার্কির মাংসের স্বাদ। এ মাংসে বেশি পরিমাণে প্রোটিন ও কম পরিমাণে চর্বি রয়েছে।  

পালন পদ্ধতি
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন, টার্কি মূলত দুইভাবে পালন করা যায়- মুক্ত চারণ পালন পদ্ধতি ও নিবিড় পালন পদ্ধতি।  

মুক্ত চারণ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে ঘেরা দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ টার্কি পালন করতে হয়। চরে খাওয়ার সময় তাদের শিকারি জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ছায়া ও শীতল পরিবেশ জোগানের জন্য খামারে গাছ রোপণ করতে হবে। চারণভূমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করতে হবে, এতে পরজীবীর সংক্রমণ কম হয়। এ পদ্ধতির সুবিধা হলো খাবারের খরচ প্রায় অর্ধেক কম লাগে, যা স্বল্প বিনিয়োগে খরচের তুলনায় লাভের হার বেশি হয়।  

নিবিড় পালন পদ্ধতিতে টার্কির বাসস্থান এদের রোদ, বৃষ্টি, হাওয়া, শিকারি জীবজন্তু থেকে বাঁচায় ও আরাম জোগায়। ব্রয়লার আর লেয়ার মুরগির মতো ঘর তৈরি করে লালন-পালন করতে হয়। তবে ঘর হতে হয় খোলামেলা আলো বাতাস আছে এমন। ঘরের মেঝে টেকসই, নিরাপদ ও আর্দ্রতারোধক বস্তু যেমন- কংক্রিটের হওয়া বাঞ্ছনীয়।

খাবার 
ফুলগাজী উপজেলার খামারি একরামুল হক একরাম জানান, একদম ছোট টার্কির বাচ্চাকে ব্রয়লার স্টেটার, এরপর লেয়ার গোবার এবং ডিম দেওয়ার সময় লেয়ার ওয়ান খাদ্য খাওয়াতে হয়। এছাড়াও টার্কি কলমির শাক ও বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাক সবজি ও ঘাস খায়। টার্কির খাদ্যের খরচও কম।  

টার্কি পালনে সম্ভাবনা 
ফেনী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আনিসুর রহমান জানান, টার্কি পালনে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এটি আমাদের দেশে মাংস উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। খামারিদের যদি সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া যায় তাহলে এ শিল্পটি বাংলাদেশে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম।  

বাংলাদেশ সময়: ১১০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৮ 
এসএইচডি/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।