ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

স্বর্ণালি মুকুল থেকে ‘গুটি’ আম্রকাননে

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৯
স্বর্ণালি মুকুল থেকে ‘গুটি’ আম্রকাননে আমের গুটি, ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: এবার শুরুটা ভালো হয়নি আম পার্বণের। মৌসুমের প্রথম থেকেই বারবার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বৈরী আবহাওয়ার। কখনও ঘন কুয়াশা, কখনও তাপপ্রবাহ আবার কখনো শিলাবৃষ্টি। দুর্যোগ যেনো পিছু ছাড়ছেই না। প্রকৃতিতে কিছু না কিছু ঘটছেই। 

প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে কি এবার আমের ফলন খারাপ হবে? না, এখনই কপালে ভাঁজ পড়ার মতো কিছু হয়নি। এবার রাজশাহী অঞ্চলের আম গাছগুলোতে যা মুকুল এসেছে তার অন্তত ৩০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকলেও দেশের আমের চাহিদা মেটানো যাবে অনায়াসেই।

 

এরই মধ্যে কুয়াশা, ঝড়-ঝঞ্ঝা আর শিলাবৃষ্টির ধকল কাটিয়ে দানা বেঁধেছে আমের গুটি। স্বর্ণালি মুকুল ঝরিয়ে শাখা-প্রশাখায় দোল খেতে শুরু করেছে সেই গুটি। চৈত্রের তপ্ত দুপুরে আগুনমুখো সূর্য যখন মাথার ওপর উঠছে তখন আম গাছের সবুজ পাতাগুলো উঠছে চিকচিক করে। আর তার ফাঁক দিয়েই উঁকি দিচ্ছে ঝাঁক ধরে থাকা মগডালের গুটি। রাতে ঠাণ্ডা আর দিনের গরম আবহাওয়ায় যেনো খাপ খাইয়ে উঠেছে আমের ছোট্ট দানাগুলোও।

সদ্য গুটি বাঁধা সেই সবুজ দানাতেই স্বপ্ন দেখছেন রাজশাহীর আম চাষিরা। দিনের সব ব্যস্ততা তাই এখন আম গাছ ঘিরেই। বছরজুড়েই আম নিয়ে কর্মযজ্ঞ চলে রাজশাহীত। তবে মৌসুমের এই বিশেষ সময়ে যত্নআত্তি বেড়ে যায়। আমগাছে কীটনাশক স্প্রে, গোড়ায় পানি দেওয়াসহ দেখভালের কাজ এখন চলছে পুরোদমে। গেলো কয়েক বছরের তুলনায় এবার রাজশাহীর প্রতিটি গাছেই পর্যাপ্ত মুকুল এসেছে। এগুলোর বেশিরভাগেই গুটি বেঁধেছে আম।  

স্থানীয় আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা কালবৈশাখীর মৌসুমে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে গত কয়েক বছরের তুলনায় রাজশাহীতে এবার আমের বাম্পার ফলন হবে।  

রাজশাহীর পবা উপজেলার পিল্লাপাড়া গ্রামের আম চাষি নুরুল আমিন জানান, এবার শীত পড়েছে কম। তবে ফাল্গুন মাসেও ঘন কুয়াশা ছিল। তাই মুকুল আসার শুরুতেই অসময়ের কুয়াশায় মুকুলের ক্ষতি হয়েছে। এরপর শুরু হলো তাপদাহ। দিনে রৌদ্রের প্রখরতা আর রাতের শীতল আবহাওয়া। এতে কিছু মুকুল বিনষ্ট হয়েছে অঙ্কুরেই। এরপর দু’দফা গেছে শিলাবৃষ্টির ধকল। সামনে তাপদাহ এবং কালবৈশাখীর শঙ্কাও রয়েছে। তবে এতো দুর্যোগের পরও প্রতিটি গাছে পর্যাপ্ত মুকুল রয়েছে। সেসব গাছের অধিকাংশেই এখন আমের মুকুল গুটিতে পরিণত হয়েছে।
গাছজুড়ে আমের গুটি, ছবি: বাংলানিউজএখন পর্যন্ত গুটি ঝরার মতো কোনো ক্ষতির মুখে পড়েনি আমগাছগুলো। কিন্তু এমন রূপে শুরু হওয়া খরা আবহাওয়া পরে রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেই বিপদ। এতে ফলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না হলে আশানুরূপ ফলন হবে বলেও প্রত্যাশার কথা জানান নুরুল আমিন।

হপার পোকার আক্রমণ দূর করতে সাধারণত দু’বার আমগাছে ওষুধ স্প্রে করতে হয় বলে বাংলানিউজকে জানান আবদুস সামাদ নামে অপর আমচাষি। তিনি বলেন, গাছে পুরোদমে মুকুল আসার পর একবার আর গুটি ধরার পর একবার স্প্রে করতে হয়।

এছাড়া গাছের গোড়ায় পানি দেওয়াসহ নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয় মৌসুম জুড়েই। ডিসেম্বরের শেষে মুকুল আসার পর জানুয়ারিতে ওষুধ স্প্রে করা হয়েছে। পুরোদমে গুটি আসার পর মার্চের শেষে অর্থাৎ, এপ্রিলের শুরুতে আরও একবার স্প্রে করতে হচ্ছে। তবে এবারের ঠাণ্ডা-গরম আবহাওয়া নিয়ে তারা একটু দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বলেন আব্দুস সামাদ।

তাই মুকুল থেকে বের হওয়া মটরদানার মতো আমের গুটিগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পরিচর্যা করছেন চাষিরা। তার ওপর মৌসুমের শুরুতেই এবার বৃষ্টি ঝরেছে।

যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বৃষ্টি আমের ভালো ফলনের পক্ষেই রয়েছে। এসময় টানা কয়েকদিন গাছের গোড়ায় পানি ঢেলেও যে লাভ না হতো, তারচেয়েও বেশি লাভ হয়েছে ওই বৃষ্টিতে। বৃষ্টির পানিতে আমের গুটি আকারে বড় হবে, ফলনও বাড়বে।

মাঝে-মধ্যে হওয়া বৃষ্টির ফল ভালো বলে উল্লেখ করেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে আমের গাছের পাতার ওপর থেকে ধুলা-ময়লা ধুয়ে গেছে। এতে পাতার মাধ্যমে মুকুলগুলো বেশি পরিমাণে সূর্যালোক থেকে খাদ্যগ্রহণ করেছে। এ কারণে গুটির ঝরে পড়া যেমন রোধ হবে তেমনি আকারও হবে বড়। তাছাড়া বৃষ্টির পরদিন পর্যাপ্ত রোদ হওয়ায় মুকুলের রুদ্র কীটপতঙ্গগুলো মারা যাবে। ফলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
আম গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক, ছবি: বাংলানিউজএবার আমের ফলন ভালো হবে বলে আশা করা যায় বলে মন্তব্য করেন এই কৃষি বিশেষজ্ঞ।

এদিকে, রাজশাহীতে এবার প্রায় ৯০ শতাংশ গাছেই মুকুল এসেছে। সেই মুকুল থেকে এখন ধীরে ধীরে গুটি আসতে শুরু করেছে। আমের প্রায় আড়াইশ জাতের মধ্যে আগাম ও মধ্যম জাতের গাছে গুটি এসেছে। তবে আরও দেরিতে গুটি আসবে সুস্বাদু মিষ্টি আম ফজলি ও আশ্বিনাসহ আরও বেশকটি জাতের।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, রাজশাহীতে প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। এই পরিমাণ জমির বাগান থেকে হেক্টরপ্রতি ১০ থেকে ১২ মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়। সে হিসাবে প্রতি মৌসুমে কমপক্ষে একলাখ ৭০ হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়। তবে এবার হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৫ দশমিক ৫৮ মেট্রিকটন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে অধিদফতর।

কয়েক বছরের তুলনায় এবার গাছে সবচেয়ে বেশি মুকুল এসেছে জানিয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, এখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকলেই হয়। তাহলে আমের উৎপাদন ভালো হবে। আমচাষিদের মুখে হাসি ফুটবে।  

শামসুল হক উল্লেখ করে বলেন, চাষিরা এখন আমগাছের নিয়মিত পরিচর্যা করেন এবং যত্ন নেন। তাই প্রতি বছরই ভালো ফলন হয়। হুট করে গরম চলে আসলেও আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলেই রয়েছে। রাতের হালকা হালকা শীত আমের উপকারী। আর এই মাসে প্রায় বৃষ্টি হচ্ছে। এটি আরও ভালো। কারণ এতে আমের গাছে আসা গুটি বেশি স্থায়ী হবে। এখন কালবৈশাখী কম হলে আমের উৎপাদন বেশি হবে বলেও আশা করা যাচ্ছে। তাই লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরা হয়েছে বলেও জানান ঊর্ধ্বতন এই কৃষি কর্মকর্তা।  

এদিকে, উত্তরের জেলা শহরগুলোর মধ্যে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁয়ের প্রায় সব এলাকাতেই এখন নতুন নতুন আমবাগান হয়েছে। প্রতি বছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। তবে নতুন আমবাগানগুলো প্রায়ই বনেদি জাতের। বিশেষ করে নিয়মিত জাত গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ক্ষিরসাপাত ও আশ্বিনা জাতের আমগাছের সংখ্যাই বেশি।

আগামী মে মাসের শেষ দিক থেকে রাজশাহীর বাজারে আম উঠতে শুরু করবে। প্রথমেই উঠবে গুটি আম, জাত আম গোপালভোগ, রানীপছন্দ ও ক্ষিরসাপাত আম। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই ল্যাংড়া, লকনা, লক্ষণভোগ, দুধসর, আম্রপালি, মোহনভোগসহ বিভিন্ন জাতের আমে ভরে উঠবে। এরপর চলতি মৌসুমের আকর্ষণীয় ফল ফজলি ও সবশেষ বাজারের ঝুড়িতে উঠবে আশ্বিনা আম।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৯
এসএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।