ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

চরাঞ্চলের তপ্ত বালুতে রসালো তরমুজ

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৯
চরাঞ্চলের তপ্ত বালুতে রসালো তরমুজ

লালমনিরহাট: ধরলা নদীর তপ্ত বালু চরে রসালো তরমুজ চাষ করে অবাক করে দিয়েছেন চরাঞ্চলের চাষিরা। চাষের পদ্ধতি জানলে চরের ধু ধু বালুতেও সোনা ফলানো যায়-এ কথাটি আবারও প্রমাণ করেছে লালমনিরহাটের চাষিরা।

জেলার আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম কুঠিবাড়ি চরের চাষিরা বালু চরে চাষ করেছেন সুস্বাদু ও রসাল তরমুজ। এ তরমুজ দেশের অন্যসব অঞ্চলের তুলনায় বেশি রসাল ও মিষ্টি বলে বাজারে এর চাহিদাও অনেক বেশি।

 

চাষিরা জানান, ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা এ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ধরলা নদীর ভাঙনে অসংখ্য পরিবার হারিয়েছেন ভিটেমাটি ও ফসলি জমি। নদীর কড়াল গ্রাসে জীবিকার একমাত্র ফসলি জমিটুকু ধু ধু বালু চরে পরিণত হয়ে অনাবাদী হওয়ায় অনেক কৃষক পথে বসে গেছেন। কেউ কেউ চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। বর্ষাকালে তাদের জমির ওপর নৌকা চললেও শুষ্ক মৌসুমে ধু ধু বালুতে পরিণত হয়। জীবিকার তাগিদে শুষ্ক মৌসুমে সেই তপ্ত ধু ধু বালু চরে সাত বছর আগে পরীক্ষামূলক তরমুজ চাষ শুরু করেন চাষিরা।

বাম্পার ফলনের পাশাপাশি বেশ মুনাফা পাওয়ায় দিন দিন বাড়ছে চরাঞ্চলে তরমুজ চাষির সংখ্যাও। এ বছর ওই গ্রামের ৩০ জন চাষি প্রায় অর্ধলক্ষাধিক চারা লাগিয়েছেন। তরমুজ চাষ করে অবাক করে দিয়েছে চরাঞ্চলের চাষিরাজীবিকার তাগিদে সীমান্তবর্তী এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এক সময় মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছিল। গত ২-৩ বছর ধরে প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযানে অনেকেই এ পথ থেকে ফিরে এসে কৃষি কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বিশেষ করে বর্তমান পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম রশিদুল হকের যোগদানের পর তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ গ্রামের বেশ কিছু মাদকবিক্রেতা আত্মসমর্পণ করে ভালোর পথে ফিরে এসে তারা সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে লেগে পড়েছেন। ফলে এক সময়ের মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত কুঠিবাড়ি এখন সবজি গ্রামের খ্যাতি পেয়েছে। গ্রামের চরাঞ্চলের জমির মালিকরা ধু ধু বালু চরে চাষ করছেন তরমুজ, মিষ্টি কুমড়া ও বাঙ্গি।

কুঠিবাড়ি গ্রামের তরমুজ চাষি তৈয়ব আলী বাংলানিউজকে বলেন, কার্তিক মাসে নদীর পানি শুকিয়ে গেলে সারিবদ্ধভাবে গর্ত করে জৈবসার দিয়ে তরমুজের বীজ রোপণ করতে হয়। এরপর নিয়মিত সেচ দিতে হয়। চারা বড় হয়ে বালুতে বিচরণ করে। প্রয়োজন শুধু দৈনিক ২-৩ বার সেচ দিয়ে তপ্ত বালুতে গাছের শিকড় ভিজিয়ে রাখা। এজন্য জমির এক পাশে শ্যালো মেশিন বসিয়ে পলিথিনের পাইপের সাহায্যে চারা গাছে পানি দেন তারা। পোকার আক্রমণ হলে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হয়। এভাবে চার থেকে পাঁচ মাস পরিচর্যা করলে পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত সুস্বাদু তরমুজ।  

তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে ৪০ হাজার টাকা খরচে তিন হাজার চারা লাগিয়েছেন। আবহাওয়াও অনুকূলে ছিলো। তরমুজ বিক্রি শুরু হয়েছে গেছে। আশা করা যাচ্ছে এবার প্রায় দেড় লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করেত পারবো।

ওই গ্রামের চাষি বেলাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, তার আড়াই হাজার চারা রোপণ করতে খরচ পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। প্রতি চারায় নূন্যতম ৪ থেকে ৬টি ফল হয়েছে। এখানকার এক একটি তরমুজ ওজনে ৭ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হয়। প্রতি পিস তরমুজ গত বছর ক্ষেতেই ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত বছর শিলাবৃষ্টিতে কিছুটা নষ্ট হলেও ৫০ হাজার টাকা আয় হয়েছে। এবছর লাখ টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। তরমুজ চাষি সৈয়াদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বালুতে পা রাখা কষ্টকর। সেই তপ্ত বালুতে গাছের শিকড় ভিজে রাখতে দৈনিক দুই থেকে তিন বার করে পানি দিতে হয়। পানির খরচই অনেক বেশি। দেশের অন্যসব অঞ্চলের চেয়ে এ চরের তরমুজ বেশি রসাল ও সুস্বাদু হওয়ায় বিক্রিতে কোনো ঝামেলা নেই। পাইকাররা শহর থেকে এসে ক্ষেতেই টাকা বুঝে দিয়ে তাদের তরমুজ ক্রয় করে বিভিন্ন শহরে পাঠিয়ে দেন।  

চলতি মৌসুমে তরমুজ ক্ষেত পোকার আক্রমণে পড়েছিলো। বালাইনাশক দিয়েও কিছু চারা রক্ষা করতে পেরেছেন বলেও জানান ওই চাষি।

কুঠিবাড়ি গ্রামের তরমুজ চাষি আবু হানিফ বাংলানিউজকে বলেন, এ জেলার অন্য কোথাও তরমুজ চাষ হয় না। তাই স্থানীয় বাজারগুলোতে এর বীজ পাওয়া যায় না। গ্রামের চাষিরা সবাই মিলে একজনকে ঢাকায় পাঠিয়ে তরমুজে বীজ সংগ্রহ করেন। তরমুজ বিক্রির সময়ও নিজেরা বিভিন্ন বাজার যাচাই করে তরমুজের মূল্য নির্ধারণ করে সম্মিলিতভাবে নিদিষ্ট মূল্যে জমিতেই পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন।  

যোগাযোগ সমস্যার কারণে পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় কিছুটা কম মূল্যে তাদের পণ্য বিক্রি করতে হয় বলেও দাবি করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই গ্রামের এক চাষি বাংলানিউজকে বলেন, এক সময় মাদকবিক্রির ডন হিসেবে খ্যাতি ছিল তার। বর্তমান এসপি যোগদানের পর শপথ বাক্যপাঠ করে মাদকবিক্রি ছেড়ে দিয়ে কৃষি কাজে ঝুঁকে পড়েছেন। ধরলার বালু চরে চলতি মৌসুমে তিনি ১০ হাজার তরমুজের চারা রোপণ করেছেন।

তিনি বলেন, মাদকবিক্রি করায় সমাজের লোকজন খুব ঘৃণা করতো। মেয়ের বিয়ে কয়েক বার ভেঙে গেছে। তাই এসপির কাছে শপথ নিয়ে মাদকবিক্রি ছেড়ে দিয়েছি। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করছি। কেউ কটু কথা বলে না।  

তবে অন্যসব মাদকবিক্রেতাদের ঘৃণ্য এ পথ ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান তিনি।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিধু ভূষণ রায় বাংলানিউজকে বলেন, সেচ সুবিধা পেলে চাঞ্চল্যে তরমুজ, মিষ্টি কুমড়া ও বাঙ্গির বাম্পার ফলন পাওয়া সম্ভব। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবছর তরমুজসহ বিভিন্ন ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৯
জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।