ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লালবাগ (পর্ব-৫)

নভেরা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২০
লালবাগ (পর্ব-৫) ..

সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।

গল্প-উপন্যাস সেই মুহূর্তগুলো ধরে রাখার উৎকৃষ্ট মাধ্যম। পুরান ঢাকার লালবাগকে যেমন সময়ের ফ্রেমে বেঁধেছেন লেখক নভেরা হোসেন। ‘লালবাগ’ একটি নভেলা। এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য পাতায়। নভেলাটি পড়তে পাঠক বাংলানিউজে চোখ রাখুন প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার।


মেডিক্যাল থেকে বেরিয়ে সোবাহান ওয়ারী যায়। ওখানে একজন সুদের কারবারি আছে, তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করা দরকার। বলধা গার্ডেনের পশ্চিম পাশে গোলাপি রঙের বাড়ি। বিশাল দালান, ছয়তলা, গেটে পোশাকপরা দারোয়ান। গেটের কাছে যেতেই একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। গেটের ভেতর কয়েকটা গাড়ি। সোবাহানের খুব পানি পিপাসা পায়, বাড়ির উল্টাপাশের দোকানে ঢুকে একটা ঠাণ্ডা পেপসি কিনে খায়।

দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে ওই গোলাপি বাড়িটা কি ফারুক সাহেবের?
দোকানদার কোনো উত্তর দেয় না নিজের কাজ করতে থাকে।

সোবাহান বাড়ির সামনে দিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। মোবাইল থেকে ফারুক সাহেবের নম্বরে ফোন করে, রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না। সোবাহানকে ফারুক সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন লালবাগের সাদেক ব্যাপারী। বলেছিলেন, কখনও যদি টাকা-পয়সার ঝামেলা হয়, তাহলে ওনাকে ফোন করতে, সাদাদিলের মানুষ টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে চড়া সুদ দিতে হবে, সই-সাবুদ দিয়ে টাকা নিতে হবে। সাদেক ব্যাপারীর ফারুক সাহেবের সাথে খুব বন্ধুত্ব।

সোবাহান গেটের কাছে গিয়ে ফারুক সাহেবকে আবার ফোন করে। দুবার রিং হবার পর ফারুক সাহেব ফোন ধরেন।

হ্যালো।
হ্যালো আস্সালামালাইকুম চাচা। আমি লালবাগের সোবাহান।
ওহ আচ্ছা।
সাদেক চাচা পাঠাইছে আমাকে।
ওহ আচ্ছা, তুমি কোথায় আছো এখন?
চাচা আপনার বাসার নিচে, গেটের সামনে।
আচ্ছা আমি দারোয়ানকে বলে দিচ্ছি, লিফটে চারতলায় চলে আসো।

সোবাহান লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, দারোয়ান ওকে ফারুক সাহেবের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেয়। বিশাল ড্রয়িং রুম। ইরানি কারপেট দিয়ে মোড়া, দেয়ালে এলসিডি টেলিভিশন, খুব নরম গদি বসানো সোফাসেট। সোবাহান ইতস্তত করছে।

একটা ছোকরার মতো ছেলে এসে সোবাহানকে বসতে দেয়। ভেতর থেকে এক গ্লাস কমলার রস আর মিষ্টি এনে খেতে দেয়। মিষ্টি খুব সুস্বাদু। সোবাহান ভাবতো ওদের পুরান ঢাকার মিষ্টি সেরা কিন্তু আজ মিষ্টি খেয়ে বোঝে ওই মিষ্টি এগুলোর কাছে কিছুই না। লাল মিষ্টি, একটা রুপালি কাগজ দিয়ে মোড়ানো, খুব সুন্দর গন্ধ আসতেছে, কয়েকটা মিষ্টি খেয়ে ফেললো।

সোবাহান কোনোদিন এতো সুন্দর বাসায় আসে নাই, ড্রইং রুমে দু সেট সোফা, লাল মখমলের গদি। দেয়ালে হাতে আঁকা ছবি ঝুলানো। ছবিতে নীল সমুদ্রে গাংচিল উড়ছে। সোবাহান হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।

কতদিন সমুদ্র দেখতে যাওয়ার কথা ভেবেছে সোবাহান কিন্তু কাজের ঝামেলার জন্য, মার অসুখের কারণে যেতে পারে নাই।

ভেতর থেকে ফারুক সাহেব বেরিয়ে এলেন। গায়ে পাতলা ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, খানদানি একটা ভাব। সোবাহান উঠে দাঁড়ায়।

বসো, বসো। তোমার আসার কথা সাদেক আমাকে জানিয়েছে।
সোবাহান মাথা নিচু করে হাত দুটো বুকের ওপর রেখে কিছুটা সংকুচিত হয়ে বসে থাকে।
তোমার মা কেমন আছে?
মায়ের শরীর ভালো না, ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি আছে। পেটে বড় একটা টিউমার, অপারেশন করতে হবে।
কী করবা বলো বাবা-মার অসুস্থতার সময়ে তাদের খেয়াল রাখা সন্তানের কর্তব্য। কোনো সমস্যা হলে আমার কাছে আসবা, মা-বাবার খেয়াল না রাখলে আল্লাহ নারাজ হন। মানুষের বিপদে কাজে না লাগতে পারলে কী লাভ আর টাকা রোজগার করে?

ছেলেটি ভেতর থেকে খাতা-পত্তর এনে দিলে ফারুক সাহেব সই-সাবুদ নিয়ে মামুদকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেন। টাকাটা হাতে পেয়ে সোবাহান হাফ ছেড়ে বাঁচে। মায়ের অপারেশনের একটা বন্দোবস্ত হলো। কৃতজ্ঞতায় সোবাহান ফারুক সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করে।

আরে করো কী করো কি? আমি তোমার সব পরিচয় জানি, লালু শেখের ছেলে। লালবাগের লোকজন আমার কাছে টাকা চেয়ে কোনোদিন ফেরত যায়নি। আমার মামার বাড়ি লালবাগ, ওইখানে অনেক স্মৃতি। ঈদের সময় মামার বাড়ি গিয়ে চাঁনরাতে মামাদের সাথে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাঘুরি, ফূর্তি, আইসক্রিম খাওয়া, চাপ, কাবাব, ফালুদা। এইসব ভোলা যায় না, বাল্যকালটা একেবারে অন্তরে গেঁথে থাকে। মার চিকিৎসা করো, তোমার কাছ থেকে সুদ নেবো না।

সোবাহান ফারুক সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী ভদ্র, দয়াশীল কিন্তু ওনার কথাই সোবাহান শুনেছে আগে মানুষ মারার কাজ করতেন। একেকবার কাজে এক থেকে দুই লক্ষ টাকা নিতেন। এখন ওই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, সুদের কারবার করেন, অনেক টাকার মালিক।

সোবাহান টাকা নিয়ে লালবাগে ফিরে আসে। কয়েকদিন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। নানা পরীক্ষা, এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড করতে হয়। সবশেষে অপারেশন হয়। অপারেশ থিয়েটারের বাইরে সোবাহান, লাইলী, বড় রানা, জুয়েল আরও কয়েকজন অপেক্ষা করতে থাকে। তিন ঘণ্টা পর অপারেশন শেষ হয় কিন্তু সোবাহানের মার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। কয়েক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়, সোবাহান নিজে এক ব্যাগ রক্ত দেয়।

সারারাত, তারপর তিনদিন ওরা হাসপাতালে বসে থাকে। সোবাহানের মার জ্ঞান ফেরে না। ডাক্তার জানিয়ে দেয় রোগীর হার্টের অবস্থা ভালো না, নাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়, নানারকম চিকিৎসা চলতে থাকে।

ডাক্তাররা একটার পর একটা ইনজেকশন দিতে থাকে। সোবাহানের মার জ্ঞান ফেরে না, কোনো আশা দিতে পারে না ডাক্তার। লাইলী হাসপাতালের বারান্দায় বসে দিন-রাত কান্নাকাটি করে, সোবাহান শক্ত মুখ করে বসে থাকে, মা কি তাহলে আর জাগবো না? মা মারে বলে সোবাহান ডুকরে কেঁদে ওঠে। হাসপাতালের নার্সরা একবার ওর দিকে তাকিয়ে চলে যায়। দুই ভাই-বোনের বুকফাটা কান্নায় হাসপাতালের বারান্দা ভারী হয়ে ওঠে। কিছু লোক ভিড় করে দাঁড়ায়, নার্সরা এসে বলে সব সরেন, সরেন, ভিড় করবেন না, যার যার কাজে যান।

লালু শেখ ঘরের দরজায় বসে কান্নাকাটি করে। কেরানীগঞ্জের এক পীরের কাছ থেকে পানি পড়া আনা হয়। শরীয়তপুরের সুরেশ্বরে লোক পাঠানো হয় কিন্তু কিছুতে কিছু হয় না।

জোৎস্না বেগম ঘুমের মধ্যে ডুবে থাকে, নাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, রাইলস টিউব দিয়ে সাদা পানির মতো খাবার দেওয়া হয়, হাতে স্যালাইন। সোবাহান মায়ের হাতে-পায়ে নখ দিয়ে চিমটি কাটে, জোৎস্না বেগম একটু নড়ে ওঠে আবার আগের মতো। এভাবে সাতদিন চলার পর জোৎস্না বেগম মারা যায়।

সোবাহান, লাইলী, লালু শেখ সবাই শোকে পাথর। ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি অপারেশন করার পর জোৎস্না বেগম বাঁচবে না। টাকা-পয়সা খরচে কোনো সমস্যা ছিল না, লালু শেখও নিজের জমানো কিছু টাকা তুলে দিয়েছিল সোবাহানের হাতে।

জোৎস্নার সাথে লালু শেখের কতকালের সম্পর্ক, একটা খবরে সব থেমে গেছে। একটা পরিবার গড়তে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয় কিন্তু সেটা শেষ হতে এক মুহূর্ত সময় লাগে না, লালু শেখ বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখের পানি ফেলে।

লালু শেখ সারাজীবনই একটু রোগাটে, শীর্ণ দেহী। সেজন্য লালু শেখের বাবা অল্প বয়সে তার বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন সবে দাড়ি-মোচ গজাচ্ছে। জোৎস্নাও খুব ছোট ছিল, বারো-তেরো বছর। দুজনে খুব ঝগড়া হতো, মারামারি হতো।

লালু শেখ বলতে থাকে, বাবা দুইজনরে মিল-মিশ কইরা থাকতে কইতো। কিন্তু আমরা খালি কাইজ্যা করতাম। তোর মা আছিল কতকটা তোর দাদির মতো। ওই বয়সে সংসারের সব দায়িত্ব নিয়ে নিছিল, বহুত ক্ষেমতাওলি। আমারে টু শব্দ করতে দিতো না। কী কমু চোখের পলকে তগো মা বদলাইয়া যাইতো। হের লগে আগে জ্বিন থাকতো, বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আইছিলো এলাকার লোকজনরে তাবিজ-কবজ দিতো। রমজানের সময় সেহেরিতে তার লগে জ্বিন দেখা করতো, নানা সুস্বাদু খানা দিতো নানারকম মেওয়া পাঠাতো। আঙুর, বেদানা মিষ্টি মাথার ওপর বৃষ্টির মতো পড়তো। তোরাতো বিশ্বাস করবি না লাইলী, তার লগে ঘুমাইতে আমার ভি ডর করতো।

লাইলী জানতে চায় আব্বা মায়ের লগে যে জ্বিন আছিলো তারে কোনোদিন দেখছেন?
দেখি নাই আবার! একজন কামেল পরহেজগার পুরুষ জ্বিন আছিল। প্রত্যেক চাঁনরাতে আমাগো সালাম দিয়া তজবি, আতর, টুপি দিতো।
এইসব কবেকার কথা বাপজান?
তোরা তখন ছোট আছিলি। সেই কামেল জ্বিন একদিন তোর মার ওপর নাখোশ হইয়া তারে ছাইড়া চইল্যা যায়, তারপর থেকেই তোর মায়ের শরীরে ব্যারাম বাসা বাঁধলো।
জ্বিন মারে ছাইড়া চইলা গেলো কেন আব্বা?
তোর মা হঠাৎ কইরা নামাজ-রোজা ছাইড়া দিল। আগে যে মানুষ জায়নামাজ নিয়ে বইসা থাকতো, সে হঠাৎ সবকিছু বাদ দিয়া দিল, খালি বাড়ির বাইরে যাইতে চাইতো। চকবাজারে এক মহিলা পীর ছিল তার বাড়ি গিয়া বইসা থাকতো। কত যন্ত্রণা যে দিচ্ছে তখন তোদের মা। তার পিছে পিছে দৌড়াইতে হইছে। বাড়ির বউ এক আধ নেংটা মাইয়ালোকের সামনে সেজদা দিয়া পইড়া থাকতো।
কি কও! আম্মা এইসব করছে কোনোদিন বলো নাই তো।
এইসব কি বলার কথা? কত টাকা পয়সা দিছে ওই পীর বেডিরে। নিজের গহনা তার হাতে তুইলা দিছে। কেমন যেন এক আছর ভর করছিল তোদের মার শরীরে। সব ওই কামেল জ্বিনের বদ দোয়া। এর কিছুদিন পর সেই নেংটা পীর এলাকা ছাইড়া চইলা গেলো, সেই থেকে তোর মা ঘরে বইলো। তার রোগ-বালাই শুরু হইলো। কিন্তু মানুষটার দিল একবারে ফকফকা, একটু কালি ছিল না   অন্তরে।
আব্বা আম্মার জন্য তোমার খুব অন্তর পোড়ে না?
লালু শেখ চোখ মুছে বিছানায় পাশ ফিরে শোয়।

নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]

আরও পড়ুন>> লালবাগ (পর্ব-৪)
                    লালবাগ (পর্ব-৩)
                    লালবাগ (পর্ব-২)
                    লালবাগ (পর্ব-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২০
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।