ঢাকা : নিজে প্রবীণ হয়েও নতুন প্রজন্মের ওপর অগাধ আস্থা স্বাধীনতা পদক জয়ী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর। একাত্তরে হানাদারদের হাতে নির্যাতিত ভিন্ন ধারার এ ভাস্কর মনে করেন, অনেক অপ্রাপ্তির এ দেশে নতুন প্রজন্মই গড়বে অমিত সম্ভাবনার ভিত।
বৃহস্পতিবার বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে এমনই সম্ভাবনার গান শোনান সংগ্রামী জীবনের অনন্য নজির গড়া ফেরদৌসী। ফাঁকে টুকটাক আলাপে আরো উঠে আসে তার জীবন-দর্শন, স্বপ্ন আর অবসরের খুঁটিনাটি।
‘বর্তমান প্রজন্ম দেশকে ভালোর দিকে নিয়ে যাবে’ বলে দৃঢ় প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এ প্রজন্মের সম্মান, আবেগ মুগ্ধ করার মতো। সারাদিন ফেসবুক, টুইটারে বুঁদ হয়ে থাকার ফাঁকেই দেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে ক্রিকেট দলকে যেভাবে প্রেরণা জোগায়, জয়োল্লাসে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলে তা ভিন্ন ধারার দেশপ্রেমই বটে। এ দেশপ্রেম লালন করেই দেশ বদলাবে নতুন প্রজন্ম। ’
প্রিয়ভাষিণীর মতে, তার আস্থাভাজন নতুন এ প্রজন্ম রাজনীতি বোঝে না। তাই কোনো রাজনৈতিক দলের খাতিরে দেশের স্বার্থে আঘাত করতেও দেবে না তারা।
স্বাধীনতা পদক হাতে ‘মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতাদের বীরাঙ্গনার পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধা বলাই শ্রেয়’ অভিমত ব্যক্ত করা প্রিয়ভাষিণী এখন ব্যস্ততাকেই জীবন বলে মনে করেন। দেশ ও জাতির কাছে খুব বেশি প্রত্যাশাও নেই তার।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘ব্যস্ততার মধ্যেই এখন আনন্দ খুঁজি। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। সবার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। ’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র সর্বোচ্চ (স্বাধীনতা পদক) সম্মান দিয়েছে। নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছে সবাই। প্রতিনিয়তই সবার কাছে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি পাই। এরচেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?’
এভাবে সচেতন জ্ঞানে প্রত্যাশার ঘোড়ায় লাগাম পরালেও দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পেতে সবসময়ই মুখিয়ে থাকেন ফেরদৌসী।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যারা যেখানে কাজের আমন্ত্রণ জানায়, সাধ্যমত করি। বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করি। এসবই আমার ভালো লাগে। ’
এতো ভালো লাগার ভেতরেও একটা কষ্ট অবশ্য খচখচ করে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ প্রিয়ভাষিণীর চেতনায়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে জোরালোভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে আসছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জীবদ্দশায় এ বিচার দেখতে চাই। প্রতিটি মুহূর্ত এ বিচারের অপেক্ষায় কাটাচ্ছি আমি। ’
একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় সময়ের কথা স্মরণ করে ফেরদৌসী বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমার কষ্টটা বেশি হয়েছিল। কিন্তু সেসব ভেবে নিজের কষ্ট বাড়াই না। বরং যা পেলাম, সে অর্জন নিয়ে খুশি থাকতে চাই। ভাবতেই ভালো লাগে, আমি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। ’
অসম সাহসী এই জীবনযোদ্ধা বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধকালে তার ওপর বয়ে যাওয়া নির্যাতনের বীভৎস কাহিনীও তুলে ধরেন অকপটে। এর উদ্দেশ্য একটাই, আরো যারা এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন তারা যেন সাহস পায়, সমাজের ভয়ে যেন কুঁকড়ে না থাকে।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলা শহরের ডাকবাংলা মোড়ের কাছে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম রওশন হাসিনা, বাবার নাম সৈয়দ মাহবুবুল হক। ১১ ভাইবোনের মধ্যে ফেরদৌসীই সবার বড়।
খুলনার পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইচএসসি ও স্নাতক ডিগ্রি নেন প্রিয়ভাষিণী।
কর্মজীবনেও অনেকটা বৈচিত্র্যময় সময় পাড়ি দেন তিনি। স্কুলে শিক্ষকতা বা কারখানার টেলিফোন অপারেটর থেকে শুরু করে কানাডিয়ান দূতাবাসসহ অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদেও চাকরিতে কেটে যায় ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত।
এরপরে ঝুঁকে পড়েন শিল্পকর্মের দিকে। এ কাজেই খোঁজেন পরিতৃপ্তি। ঝরাপাতা, মরা ডাল বা গাছের গুঁড়ির নানামুখী ব্যবহার তার শিল্পকর্মকে করে তোলে আরো বৈচিত্র্যময়।
বাংলাদেশ সময় : ১৮০৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১২
এআর/
সম্পাদনা : জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর