সিলেট: বৃহত্তর সিলেটজুড়ে চলছে ইউনিপেটুইউ’র ডিজিটাল প্রতারণা। সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলতে প্রায় দুই হাজার দালালের একটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তুলেছে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের এ নতুন কোম্পানি।
দালালচক্রে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল, ডাক্তার, পুলিশ কর্মকর্তা, সাধারণ ব্যবসায়ীকে যেমন ভেড়াতে পেরেছে, তেমনি এ চক্রে নাম লিখিয়েছে শিক্ষার্থী থেকে গাঁয়ের গৃহবধূরাও।
এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের অজান্তেই এ প্রতারণা ব্যবসার চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছেন। লোভনীয় ও অবাস্তব সব প্রস্তাব নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন মানুষের ঘরে ঘরে।
সহজ সরল মানুষজনকে নানা কল্পকাহিনী শুনিয়ে ইউনিপেটুইউ’র কথিত সোনা বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট করার প্রচারাভিযান চালাচ্ছে তারা বেশ জোরেসোরেই।
আর এভাবেই মানুষের বহু কষ্টে জমানো টাকা, সহায়-সম্পদ বিক্রির অর্থ, এমনকি ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙ্গানো কাড়ি কাড়ি টাকা অনলাইন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে ইউনিপেটুইউ।
শুধুমাত্র একটি ওয়েবসাইটকে পুঁজি করে প্রতাণনার এ অভিনব ও ভার্চুয়াল পদ্ধতিকে সিলেটের সচেতন বাসিন্দারা ‘ডিজিটাল প্রতারণা’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন।
তারা বলছেন, সিলেটের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে বিভাগের ২৫টি থানাজুড়েই প্রতারণার বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে ইউনিপেটুইউ।
জানা গেছে, এ নেটওয়ার্কে তিন শতাধিক এজেন্ট রয়েছে। এসব এজেন্টের আওতায় আছে আরও প্রায় দু’ হাজার দালাল। এরা ‘বিনিয়োগকারী শিকার’ ধরতে বিভাগের প্রতিটি শহর-গঞ্জ-গ্রাম দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
ঘরে ঘরে ঘরোয়া বৈঠকের পাশাপাশি সভা-সেমিনার করেও তারা সাধারণ মানুষকে অকল্পনীয় লাভের লোভ দেখিয়ে সর্বস্বান্ত করার পাঁয়তারা কষছে।
সোমবার সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারের আলমারজান মার্কেটে ‘গ্রাহক উদ্বুদ্ধকরণ সংক্রান্ত’ এ রকমই এক সেমিনারের আয়োজন করে ইউনিপেটুইউ’র সোনা বাণিজ্যের দালাল চক্র।
সেমিনারে সিলেট শহরের প্রভাবশালী এজেন্ট লোকমান হোসেন বলেন, ‘কিছু কিছু গণমাধ্যম ইউনিপেটুইউ’র বৈধ বাণিজ্যকে ভুয়া ও প্রতারণামূলক বলে চিহ্নিত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। সাংবাদিকরা আমাদের ব্যবসার ধরন ও মুনাফা অর্জনের বিষয়ে কোনো কিছু জানেন না বলেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কয়েক লাখ বাংলাদেশি যে কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে জমা দিচ্ছি সে টাকা দিয়ে ইউনিপেটুইউ’র কর্পোরেট অফিসের কর্মকর্তারা আফ্রিকার বিভিন্ন সোনার খনি থেকে তরল সোনা কিনে থাকে। পরে প্রতি কেজি সোনায় তারা একশ’ গ্রাম পরিমাণ খাদ মিশিয়ে তা আন্তর্জাতিক সোনার বাজারে চড়া মূল্যে বিক্রি করে। প্রতি মাসে গড়ে ৪ দফা চক্রাকারে এ ব্যবসা করে ইউনিপেটুইউ। ’
এরপর লোকমান যা বলেন তা রূপকথাকেও হার মানায়, হার মানায় অবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকেও।
তিনি বলেন, ‘শুধু খাদ মেশানোর এ পদ্ধতিতে প্রতি সপ্তাহে শতকরা ১০ ভাগ, মাসে ৪০ ভাগ এবং ১০ মাসে শতকরা ৪শ’ ভাগ আয় করে ইউনিপেটুইউ। সেখান থেকে বিনিয়োগকারী সদস্যদের মাঝে শতকরা মাত্র একশ’ ভাগ লাভ দেয় তারা। ’
এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বলেও দাবি করেন লোকমান হোসেন!
তবে লোকমানের এসব কল্পকাহিনী উড়িয়ে দিয়েছেন তার সঙ্গী এজেন্টরাই।
তারা বলেন, লোকমান এসব মনগড়া কল্পকথা প্রচার করেই নিজ এজেন্সির আওতায় সাড়ে চার হাজার সদস্য করেছেন। গত ৭ মাসে এসব সদস্য অন্তত ৬০ কোটি টাকা ইউনিপেটুইউকে দিয়েছে।
সিটি সেন্টারের ৮ তলায় এজেন্ট মোহাম্মদ কামাল ধাই (আইডি নং-বি-৮১৯১৬৪১)’র সহযোগী এজেন্ট আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘খাদ মিশিয়ে সোনা বেচাকেনা সংক্রান্ত কল্পকথার কোনো ভিত্তি নেই। এটা ইউনিপেটুইউ’র বক্তব্য নয়, লোকমানের মনগড়া কথা। এসব ভিত্তিহীন বক্তব্যের দায় ইউনিপেটুইউ বা আমরা কেউ নিব না। ’
তাহলে দ্বিগুণ লাভের উৎসটা কী-এ প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওয়েবসাইটে ইউনিপেটুইউ বিষয়ক সব তথ্য দেওয়া আছে। সেসব তথ্য বিশ্বাস করে টাকা জমা দেওয়ার রিস্ক (ঝুঁকি) নিয়ে আমরা সফল হয়েছি। আপনার বিশ্বাস হলে রিস্ক নিয়ে টাকা জমা দিতে পারেন, অবিশ্বাস হলে দিবেন না। ’
তিনি আরও বলেন, কোনো কারণে বিনিয়োগের টাকা গচ্ছা গেলে তার দায়-দায়িত্ব কোনও এজেন্টই নিবে না। বিনিয়োগের টাকা ফেরতও দিতে পারবে না কেউ।
এজেন্ট আনোয়ার হোসেনের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় রোববার সিটি ব্যাংক শাখায় গিয়ে। সেখানে জুলাই মাসে এক লাখ টাকা জমা দিয়ে ইউনিপেটুইউ’র সদস্য হয়েছিলেন আলীনগর এলাকার ঠিকাদার নোমান আহমেদ (৪০)।
টাকা জমা দেওয়ার ৩০ দিন পর থেকে লভ্যাংশ পাওয়ার কথা থাকলেও গত তিন মাসে তিনি কোনো টাকাই পাননি।
নোমান আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘ঠিকাদারী কাজ পাওয়ায় এ মুহূর্তে টাকাগুলো খুব দরকার। এজন্য ইউনিপেটুইউ’র এজেন্ট ও সিটি ব্যাংক শাখায় ছুটে যাই। কিন্তু ব্যাংক শাখায় নিজের হাতে জমা দেওয়া আসল টাকাটাও এখন তুলতে পারছি না। ’
এজেন্ট শফি মিয়া নোমানকে তার সদস্য পরিচয় পত্র (আইডি) ও পাস কোডটি আরেকজন আগ্রহী প্রার্থীর কাছে বিক্রির মাধ্যমে টাকা তুলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে এজেন্টের এ পরামর্শও কাজে লাগাতে পারছেন না নোমান। কেউই কিনছে না তার আইডি।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘গত ১০/১২ দিন ধরে এজেন্ট অফিস আর ব্যাংক শাখায় ঘুরে ঘুরে কান্ত হয়ে পড়েছি। কারো কাছেই আমার সদস্য আইডিটি বিক্রি করতে পারছি না। তুলতে পারছি না টাকাগুলোও। ’
নোমান টাকা তোলার ব্যাপারে সিটি ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখায় গেলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘ইউনিপেটুইউ’র নামে নির্ধারিত অ্যাকাউন্টে টাকা শুধু জমা দেওয়া যায়, তুলে নেওয়ার কোনো পদ্ধতি নেই। ’
বাংলাদেশের সময় : ১৫৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১০