ঢাকা, বুধবার, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৪ জুন ২০২৫, ০৭ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সংসদবিহীন বাজেটের আইনি ভিত্তি কী?

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:১৫, জুন ২, ২০২৫
সংসদবিহীন বাজেটের আইনি ভিত্তি কী?

ঢাকা: আইনসভায় যেসব আইন পাস হয়, তার মধ্যে বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, সংসদীয় ব্যবস্থায় বাজেটের মতো ‘মানি বিল’ প্রত্যাখ্যাত হলে তাকে সরকারের প্রতি অনাস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

অথচ তেমনই গুরুত্বপূর্ণ বাজেট উপস্থাপিত ও পাস হবে সংসদ ছাড়াই। এ প্রক্রিয়ায় বাজেট পাসের আসলে তেমন একটা আইনি ভিত্তি নেই বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে আইনের জন্য তো আর জীবন থেমে থাকবে না, তাই শেষ পর্যন্ত নির্বাহী আদেশেই পাস হবে চূড়ান্ত বাজেট।

বাংলাদেশে অবশ্য এভাবে বাজেট হওয়া একেবারেই নতুন তা নয়। কারণ, এর আগেও একাধিকবার সংসদের অনুপস্থিতিতে পাস হয়েছে বাজেট। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে যে সংসদ আসবে, সেখানে পাস করার মাধ্যমে তার আইনগত ভিত্তি চূড়ান্ত হবে বলে মনে করেন আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।

যেভাবে উত্থাপন হবে বাজেট
সোমবার (০২ জুন) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বেলা তিনটার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্য পেশ করবেন। বাজেট বক্তব্য শেষ হওয়ার পর (https://mof.gov.bd/) ওয়েবসাইটে খসড়া বাজেট মিলবে। আগামী ৩ জুন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হবে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। যেহেতু সংসদ নেই তাই খসড়া বাজেটের ওপর বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হবে। এরপর গৃহীত সংশোধনী শেষে জুন মাসের শেষ দিকে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে। এর মাধ্যমে খসড়া বাজেটটি আইনে পরিণত হবে।
সংসদ ছাড়া আরও যেসব বাজেট হয়েছে 

সংসদ ছাড়া যেসব বাজেট হয়েছে, তার মধ্যে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার, এরশাদ সরকার ও দুটি ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ের বাজেট অন্তর্ভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধকালীন ব্যয় মেটানোর জন্য মুজিবনগর সরকার একটি বাজেট পাস করে। অবশ্য স্বাধীনতার পর তাজউদ্দিন আহমেদ একসঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করলে একসঙ্গে দুটি বাজেট সংসদে পাস হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর ওই বছর ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে বঙ্গভবন থেকে বাজেট ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও অর্থ উপদেষ্টা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পাশাপাশি অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে আরও দুটি বাজেট উত্থাপন করেন তিনি।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। এরপর তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে সচিবালয় থেকে টেলিভিশনের মাধ্যমে বাজেট পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সবশেষ ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে একইভাবে বাজেট উত্থাপন করেন তৎকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জা এ বি আজিজুল ইসলাম।

বাজেট চূড়ান্তভাবে গ্রহণের প্রক্রিয়া 

বাজেট চূড়ান্তভাবে গৃহীত হবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে। সাধারণত সংসদ বহাল না থাকাবস্থায় আইন পাস করার এটাই সবশেষ আইনি ভিত্তি। আর্থিক বিষয়েও সংসদের ন্যায় অধ্যাদেশ জারি করা যাবে। সংবিধানের ৯৩(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ ভাঙিয়া যাওয়া অবস্থার কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট ব্যবস্থা-গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি এমন অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন, যাহাতে সংবিধান-দ্বারা সংযুক্ত তহবিলের ওপর কোনো ব্যয় দায়যুক্ত হউক বা না হউক, উক্ত তহবিল হইতে সেইরূপ ব্যয় নির্বাহের কর্তৃত্ব প্রদান করা যাইবে এবং অনুরূপভাবে প্রণীত কোনো অধ্যাদেশ জারি হইবার সময় হইতে তাহা সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে। ’

তবে ৯৩(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার অধীন জারিকৃত প্রত্যেক অধ্যাদেশ যথাশীঘ্র সংসদে উপস্থাপিত হইবে এবং সংসদ পুনর্গঠিত হইবার তারিখ হইতে ত্রিশ দিনের মধ্যে এই সংবিধানের ৮৭, ৮৯ ও ৯০ অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী প্রয়োজনীয় উপযোগীকরণসহ পালিত হইবে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

সংসদ না থাকা অবস্থায় এভাবে বাজেট পেশ করাকে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতিতে আসলে অধ্যাদেশ দ্বারা বাজেট প্রণয়ন ছাড়া অন্য কিছু করার নেই বলেও মনে করেন তারা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা হচ্ছেন মন্ত্রীদের পদমর্যাদায়। কিন্তু তারা সংসদ সদস্য নন। বর্তমান অবস্থায় তাদের এই বাজেট প্রণয়নকে আমি মনে করি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ডকট্রিন অব নেসেসিটির মধ্যে পড়ে।

কারণ, সংসদ না থাকলেও দেশ তো চালাতে হবে। ব্যয় নির্বাহ করতে হবে। এটি একটি ক্রান্তিকালীন অবস্থা। আর কখন ক্রান্তিকাল আসবে, এটা কেউ জানে না। আজকে যদি ভূমিকম্পে দেশ ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে কি হবে সেটা তো আর সংবিধানে লেখা থাকবে না। তেমনিভাবে যদি একটি গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার বিদায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়, এটাও কেউ জানতো না। তাই এটাকে সেভাবে গতানুগতিক আইনি ফ্রেমে বাঁধা যাবে না। তবে যেই বাজেটই প্রণয়ন করা হোক, সেটা পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন নিতে হবে।

প্রায়ই একই ধরনের অভিমত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরীর। বাজেট প্রণয়নের এই প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখন তো একটা ট্রান্সিশনাল গভর্নমেন্ট চলছে। এ সময়ে তো অনেক কিছুই হচ্ছে, যা সংবিধানে নেই। তখন সব কাজগুলো অধ্যাদেশ দিয়ে করা হয়। পরবর্তীতে যখন পার্লামেন্ট গঠন হবে, তখন সেগুলো পার্লামেন্টে অনুমোদন নিতে হবে।

পূর্ববর্তী সময়ে এভাবে বাজেট পেশের নজির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এর আগে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক সরকারের আমলে এভাবে সংসদ ছাড়া বাজেট দেওয়া হয়েছে। তখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ, সামরিক শাসন চলাকালে তো আর সংবিধান বহাল থাকে না।

কেআই/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।