ঢাকা: অর্থ সংকটের কারণে বিদ্যুতের কম উৎপাদন করছে সরকার। বর্তমানে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা থাকলেও দিনে কমবেশি চার হাজার এবং রাতে কমবেশি পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
দিন-রাত এমন কি বর্ষা নেমে আসার পরও বিদ্যুতের চাহিদা কমলেও থামছে না লোডশেডিং। গ্রাম-শহর সবখানেই। সোমবার আবহাওয়া শীতল থাকলেও রাজধানীর প্রায় সব অঞ্চলেই অন্যান্য দিনের সিডিউল মতো লোডশেডিং দেওয়া হয়েছে। কুষ্টিয়া, রংপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ব্যাপক লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে।
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা মাসুম মিয়া বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, আগে একটা নিয়ম মানতো বিদ্যুৎ। এখন তাও মানছে না। অতীতে আমরা দেখেছি বৃষ্টি হলে লোডশেডিং থাকে না।
কিন্তু এখন একেবারেই উল্টো।
সোমবার দিনে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকলেও লোডশেডিং ছিল অন্যান্য দিনের মতোই। সকাল ১১টায় প্রথমে সোয়া ঘণ্টা, পরে দুপুর আড়াইটায় আবার এক ঘণ্টার জন্য লোডশেডিং দেওয়া হয়। এছাড়া বিকেল চারটায় আরেক দফা লোডশেডিং দেওয়া হয়।
পিডিবি জনসংযোগ পরিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ‘ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় আংশিক উৎপাদন করা হচ্ছে লস (ক্ষতি) কমাতে। বর্তমানে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে দিনে প্রায় ১৪ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে সরকারের। সারাদিন এসব কেন্দ্র চালু রাখতে হলে সরকারকে ৪০ কোটি টাকার বেশি গুনতে হবে। ’
তিনি দাবি করেন, ‘বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ গড়ে প্রতি ইউনিট পাঁচ টাকা ৭০ পয়সা, আর প্রতি ইউনিট বিক্রি করা হচ্ছে চার টাকা ২ পয়সায়। সে কারণে যতো উৎপাদন কম করা হবে ততই ক্ষতি কমবে। ’
বিদ্যুতের গড় দাম তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনের সাপেক্ষ। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ালে গড় উৎপাদন ব্যয় জ্যামিতিক হারে বাড়তে পারে।
তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি খরচ পড়ে আট থেকে ২৮ টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে, একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে (বড়পুকুরিয়া) সোয়া চার টাকা এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে সোয়া দুই টাকা দরে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা প্রথম থেকেই তেলভিত্তিক ও রেন্টাল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সমালোচনা করে আসলেও সরকার কখনোই আমলে নেয়নি।
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ‘সাধারণত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানো হয়। আর আমাদের দেশে গণহারে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে এই খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ তোলা হয়েছে। সরকার দফায় দফায় দাম বাড়াচ্ছে কিন্তু সেবা বাড়ানো তো দূরের কথা, স্বাভাবিক সেবাও দিতে পারছে না। ’
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, সরকার পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন বন্ধ রেখে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন দফায় দফায় দাম বাড়ালেও রক্ষা হবে না।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সারা দেশের সব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এক ঘণ্টা চালাতে তেল লাগে প্রায় চার লাখ লিটার। এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করাও জরুরি। দিনে দিনে উৎপাদন খরচ বাড়ছে কিন্তু সরকার সে হারে দাম বাড়াতে পারছে না। ফলে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে পিডিবি। ’
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন চুক্তি করেছে। এসব কেন্দ্রের মধ্যে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট তিনটি (২৬৫ মেগাওয়াট), ১৭টি কুইক রেন্টাল (এক হাজার ৩৮৮ মেগাওয়াট), ১৪টি আইপিপি ( ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট, এক হাজার ৮৭০ মেগাওয়াট), বেসরকরারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৮টি (দুই হাজার ১০ মেগাওয়াট)। মোট পাঁচ হাজার ৫৩৩ মেগাওয়াট উৎপাদন করতে সক্ষম এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ২৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এক হাজার ৩৩৬ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। বাকিগুলো ২৪টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, ‘দিন যতো যাবে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকবে। আইপিপি থেকে গড়ে আট টাকা দরে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। একই সময়ে ভর্তুকি দিয়ে তেল সরবরাহ করতে হবে সরকারকে। ’
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আবুল কালাম আজাদ এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০১৩ সালের পর আর নতুন তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আসবে না। বর্তমানে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, বিগত সময়ে স্থবিরতা কাটাতে এর বিকল্প ছিল না। তা না হলে এ সময়ে ভয়াবহ লোডশেডিং হতো।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১২
ইএস/
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর