ধলেশ্বরী পাড় (মুন্সীগঞ্জ) থেকে ফিরে: বাড়ির উঠানে শুয়ে রয়েছেন মোসাম্মৎ জহুরা বেগম। আটদিন পর মঙ্গলবার ‘কবর’ থেকে বের হয়েছেন।
‘কবরে’ তার মাথার উপরে একপাশে একটি ছোট হাত ঢোকার মতো ফাঁকা জায়গা রয়েছে। সেখান দিয়েই সন্ধ্যার পর একটি গ্লাসে করে দুধ দিতেন ছোট ছেলের বৌ মোসাম্মৎ জয়ফুল বেগম।
![](../../../images/PhotoGallery/2012May/A-120120508211341.jpg)
এর আগেও চার বার ‘দয়ালে’র ইশারায় ‘কবরে’ গেছেন জহুরা বেগম। কবর থেকে বের হওয়ার পর কয়েকদিন আর কারও সঙ্গে কথা বলেন না তিনি। জবান বন্ধ থাকে। শুধু কথা বলেন বড় ছেলে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। রফিকুল ইসলামকে অনুরোধ করলে নিয়ে যান জহুরা বেগমের সঙ্গে কথা বলতে।
অশীতিপর বৃদ্ধাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তার আত্মীয়-স্বজন। রফিকুল ইসলামের অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করি, শরীরে কোনো অসুস্থতা বোধ হচ্ছে কি না? জবাবে মাথা নাড়েন বৃদ্ধা।
``কেন আপনি কবরে যান ?এবাদত করতে?``-- উত্তরে দুর্বল গলা থেকে একটি মাত্র শব্দ বের হয়, ‘দয়াল’।
কবর থেকে কোলে করে জহুরা বেগমকে নিয়ে আসেন মেজো ছেলে অলিউল্লাহ। তারপর গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে উঠানে শোয়ানো হয়।
জহুরা বেগম কোনো ভণ্ডামি করেন না। কাউকে দাওয়াত দেন না। প্রায় ৩৪ বছর ধরে কবরে শোয়া ও জিকির চলছে তার।
![](../../../images/PhotoGallery/2012May/A-420120508211327.jpg)
বাবা আবেদ আলী গৃহস্থালি করতেন। ৭-৮ বছর হয়েছে তিনি মারা গেছেন।
``কবরে’ থাকার পুরো ব্যাপারটাই তার ইচ্ছাকৃত, তার কাজ হলো আল্লার জিকির। জিকিরের মধ্যে তাকে কে কী বলে, তা তিনি জানেন। ``
বের হওয়ার পর কয়েকজন বলছিল শুকিয়ে গিয়েছেন বৃদ্ধা। রফিকুল বললেন, ``উনিতো আগে থেকেই শুকনো। গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে উনি ওখানে গেছেন। কিছু খান না, শুধু সন্ধ্যার পর ইফতারির সময় এক পোয়া দুধ খান। শারীরিক অসুস্থতা নেই বলেও জানান তিনি। ``
![](../../../images/PhotoGallery/2012May/A-320120508211411.jpg)
``এ চিন্তা করেই উনি আবার পেঁয়াজ কাটতে যান, কিন্তু পেঁয়াজ কাটতে পারেন না। এরপর আবার ঘুমিয়ে যান। আবার আগের স্বপ্নের মতোই হয়তো দেখলেন। এবার ঘুম থেকে উঠে বললেন, হায় আল্লাহ আমাকে একি দেখালো! এ কি দেখলাম!``
``এরপর জিকির শুরু করেন, যখন জিকির করেন কথা বলতে পারেন না। আবার জিকির শেষ হলে কথা বলেন। ``
এ প্রতিবেদককে রফিকুল ইসলাম বললেন, ``১১ শরিফ বুঝেন কিনা জানি না, প্রতি চান্দের ১১ তারিখে একটা মিলাদের ব্যবস্থা করা হয় এখানে। আয়োজন কম হোক আর বেশি হোক একটা মিলাদের ব্যবস্থা হয়। হয়তো মসজিদের ইমাম সা`ব আসেন, ময়-মুরুব্বিরা আসেন। জিকির-টিকির হয়। ``
``একসময় এ কথা জানাজানি হয়ে যায়। অনেকে বলা শুরু করল, মা পাগল হয়ে গেছে, আবার অনেকে বলল ভূতে ধরছে। ২-১ দিন পার হলে আমি ঢাকা থেকে খবর পেয়ে আসি। ``
``ঢাকা থেকে আসার পরদিন দুপুরে আমার বড় চাচি, (বড়মা ডাকতাম, এখন মারা গেছেন) শুনলাম আমার মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কীভাবে কি হইলি? কি আসয়-বিষয় কি হইলো?``
![](../../../images/PhotoGallery/2012May/A-520120508211319.jpg)
এই প্রতিবেদককে রফিকুল বলতে থাকেন, `` দুই ঘরের মাঝখানে পেঁয়াজ ছিল। আরেক পাশে কথা বলছিলেন তারা (মা ও বড়মা)। ``
``আমি সেদিন নিষেধ করতে পারি নাই। নিষেধ করলে আমার বড়মা কষ্ট পেতে পারেন। ভাববে ‘উই (সে) এখন মাতবর হয়া গেছে। সইতে পারছি না, বলতেও পারছি না। ``
প্রতিবেদককে রফিকুল বলেন, ``যদি আপনি পাইয়া থাকেন, বুঝতে পারবেন, আল্লার কি শক্তি, আল্লা-ডাক কত মধুর। যে ওই পথে না ঢুকেছে সে বুঝতে পারবে না। ভেতরে আমার যে একটা জ্বালা। ওখানে টিকতে না পেরে, মা যেখানে শুতেন সেখানে আমিও গিয়ে শুলাম। ``
``আমারও হাল খারাপ হয়ে পড়ে। বাবা ও আমার বৌ বলল- আগে মা পাগল হয়েছে, এখন আমিও পাগল হয়ে গেছি। আমার হাল খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমার বৌ- বোনেরা এসে আমাকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। মনে হচ্ছিল আমি যদি বুকের ভেতরে চাপা পড়া জিনিসটা বের করে দিতে পারতাম। মুক্ত হয়ে যেতে পারতাম। অবশেষে আল্লাহ আমাকে শান্ত করলো। যাই হোক জবান বন্ধ হলো। একটু পর ঠিক হলো। মা বলল- ওর কাছে এখন কেউ যেও না, ও ঠিক আছে। ``
রফিকুল বললেন, ``আমার মা`র তো ধন দৌলতের লোভ নাই। কাউকে বলে না, আমাকে একটা আপেল দাও, কিছু দাও। তিনি কখনো আমাদের কাছেও কিছু চান না। তবে আমাদের বলে দিয়েছেন- হারাম রুজির টাকায় যেন কিছু না খাওয়াই। ``
এরপর অনেকে আসত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। অনেক সময় মা আমাকে দেখিয়ে দিত। এটা কেমন যেন হয়ে গেল। এরপর এক সময় বন্ধ হয়ে গেল। আমার বাবা প্রথম প্রথম কিছু বললেও পরে কিছুই বলতো না। কিন্তু হয়তো বাজারে গেলে যদি কেউ বলতো, তোর বৌ পাগল হয়ে গিয়েছে তখন মন খারাপ করতো। বাবা হয়তো কিছু বললে মা মন খারাপ করতেন, জিকির করতে না পারলে তার ভাল লাগতো না। আমি বলতাম- আপনার যেখানে গেলে ভাল লাগবে, শান্তিতে থাকবেন সেখানেই নিয়ে যাব। ``
রফিকুল ইসলামের বাবা পীর ফালু শাহ’র মুরিদ ছিলেন। পীরের বাড়ি ছিল কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ, মুরাপাড়ায় গাউছিয়া মার্কেটের পাশে।
ফালু শাহের পীরের বাড়ি ছিল লাকসামে। ওই পীরের পীর ছিলেন চিটাগাংয়ের মাই শাহ। এখনকার ছবিউল শাহ নন, উনি হয়তো ছবিউল শাহর দাদা ছিলেন।
লাকসামের পীরের নাম মনে নাই রফিকুল ইসলামের। লাকসামের ওই পীরের অনেক মুরিদ আছে এখানে। এখনো এখানে আসেন, মিলাদ পড়েন। এখনো বুজুর্গানদের বা আলেম-পীরদের নিমন্ত্রণ করে মানুষ। রফিকুল বলতে থাকেন, ``পীরের মুরিদ হওয়ায় বাবার প্রভাব পড়ে মা এর উপরও। আমাকে মানুষ বলতো, তোমার বাবা পীর, মা পীর, তুমিও পীর। আমার বাবা-চাচা এখানকার অনেকেই পীর ফালু শাহর মুরিদ হয়েছিলেন। ফালু শাহ আসতেন। ফালু শাহ তো বুঝতেন, উনি কাউকে বলে যাননি এটা করা যাবে না। এলাকায় মুরুব্বি ও আধ্যাত্মিক গুরু যারা তাদের বলেছিলেন উনার যেন কোনো সমস্যা না হয়। ``
জহুরা বেগমের ভাগিনা বৃদ্ধ আক্কাস মিয়া জানান, ``এবার তার মামী নিয়ত করেছিলেন ৪১ দিন থাকবেন কবরে। কিন্তু ছেলে মেয়েরা কান্নাকাটি করায় কমিয়ে ৮ দিনে নামিয়ে আনেন। ``
৬ ছেলের প্রথম জন মারা গেছে জহুরা বেগমের। তিন মেয়ের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে।
রফিকুল ইসলাম জানান, জহুরা বেগম প্রথমে এ-কবরে ছিলেন আড়াই দিন, তারপর তিন দিন, এরপর চার দিন, এরপর পাঁচ দিন। এবার একসঙ্গে আটদিন।
``তিনি সেখানে দয়ালের ইশারায় থাকেন। কোনো খাওয়া-দাওয়া করেন না। ``
বাংলাদেশ সময় ১৯৪০, মে ৮, ২০১২
এমএন/এআর/
সম্পাদনা: রানা রায়হান ও জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; আহমেদ রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট;
জুয়েল মাজহার,কনসালট্যান্ট এডিটর