ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

দুদকের সঙ্গে প্রথম বৈঠক রোববার

ঘুষের তালিকা নিয়ে আসছে বিশ্বব্যাংক!

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১২
ঘুষের তালিকা নিয়ে আসছে বিশ্বব্যাংক!

ঢাকা: পদ্মাসেতু প্রকল্প দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে যারা অভিযুক্ত কানাডা পুলিশের কাছ থেকে তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এবং দুর্নীতির সকল দালিলিক নথিপত্র নিয়ে রোববার ঢাকায় আসছে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। এদিন সকালে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের তিন সদস্য লুইস মোরেনো ওকাম্পো, টিমথি টং ও রিচার্ড ওন্ডারম্যান ঢাকায় পৌঁছাবেন।

আর বেলা এগারটায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে প্রথম বৈঠক করবেন।

দুদকের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে এ তথ্য জানিয়েছেন। দুর্নীতির তদন্ত খতিয়ে দেখতে এটি হবে বিশ্বব্যাংকের প্রাথমিক পর্যায়ের পরিদর্শন।

সূত্র জানায়, গত জুন মাসে পদ্মাসেতু প্রকল্পে এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে যাদের ঘুষ দিতে হবে এমন কিছু ব্যক্তির নামের তালিকার `যৎ-সামান্য` দুদকে পাঠিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। রোববার পদ্মাসেতু দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের তালিকা, কানাডা পুলিশের তদন্তের সকল তথ্য-উপাত্ত এবং নথিপত্রসহ রমেশের জব্দকৃত ডায়েরির পুরো ফটোকপি নিয়ে আসছে তিন সদস্যের এ প্যানেল।

এ প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কানাডিয়ান রয়াল পুলিশের অগ্রগতিমূলক তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার নথিও রয়েছে বলে জানা গেছে। আর এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দুদকের মুখোমুখি হবে বিশ্বব্যাংকের প্যানেল।

বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সন্তুষ্টির ওপরই নির্ভর করছে স্বপ্নের পদ্মাসেতুর ভাগ্য!

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের অনুসন্ধান টিমের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ``দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে বিগত দিনে দুদকে যৎসামান্য তথ্য দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এবার বিশ্বব্যাংকের কাছে থাকা সব ধরনের তথ্য, নথিপত্র দেওয়া হবে দুদককে। ``

কানাডা থেকে বিশ্বব্যাংকের প্যানেল দুর্নীতির তথ্য নিয়ে আসছে এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, ``কানাডা পুলিশের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঘুষ নিয়েছেন এমন কয়েকজনের তালিকা আছে তবে তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। এটা এখনও অভিযোগ। ``

রোববার প্যানেলের ৩ বিশেষজ্ঞ প্রথমে বৈঠক করবেন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. বদিউজ্জামান, কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে। এরপর বৈঠক করবেন দুদকের অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে। অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে বৈঠকে শুধু অনুসন্ধান কমিটির কর্মকর্তা ও প্যানেলের তিন সদস্য থাকবেন।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

বিশ্বব্যাংক প্যানেলের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে গত চার কর্মদিবসে দুদক চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে কয়েকদফা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। বৈঠকে পদ্মাসেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত কী ধরনের ত্রুটি, বিচ্যুতি পাওয়া গেছে, অভিযোগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত কতজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, আরও কী কী কাজ করতে হবে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

বিশ্বব্যাংকের প্যানেল যাতে চাওয়া মাত্রই সকল তথ্য উপস্থাপন করতে পারে সেজন্য দুদকে শেষ মূহুর্তের প্রস্তুতি চলছে। একদিন পরই বিশেষজ্ঞ প্যানেল আসবে। তাই দুদকের অনুসন্ধানও টিম দিন-রাত কাজ করছে।

দুদকের ৪ সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান কমিটিতে রয়েছেন, সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী, এএসএম আবদুল আল-জাহিদ,  গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও মির্জা জাহিদুল আলম। এ টিমকে সার্বিকভাবে সহায়তা করবেন মহাপরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত) খোন্দকার আমিনুর রহমান।

দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ``বিশ্বব্যাংকের প্যানেলকে বরণ করতে আমরা এখন প্রস্তুত। আমরাও চাই তারা এসে প্রত্যক্ষ করে দেখুক আমাদের কার্যক্রম স্বচ্ছ কি-না!"

সূত্র জানায়, কানাডিয়ান পুলিশ তদন্তকালে এসএনসি-লাভালিনের অফিস থেকে পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজকর্ম সংক্রান্ত একটি ডায়েরি জব্দ করে। ওই ডায়েরিতে ঘুষের টাকা দাবি সংক্রান্ত তালিকাটি পাওয়া যায়। কানাডিয়ান পুলিশ তদন্তের কিছু তথ্য-উপাত্তসহ নামের তালিকাটি বিশ্বব্যাংকে পাঠায়। বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে ওই তালিকা `যৎসামান্য` দুদকে পাঠিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও বিশদ তথ্য নিয়ে রোববার দুদকের সামনে হাজির হবে প্যানেলের তিন সদস্য।

প্যানেলকে সহযোগিতা করেছে কানাডা

বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের এ প্যানেলকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে কানাডা পুলিশ ও সে দেশের সরকার। এ কয়দিনে বিশ্বব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী সকল তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে কানাডা। আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া এসএনসি-লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে দুহাইমে ও এসএনসি-লাভালিনের অফিস থেকে জব্দ করা নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ লেনদেন বিষয়ে যে তথ্য পেয়েছে কানাডা পুলিশ তা এরইমধ্যে বিশ্বব্যাংককে দিয়েছে। সেসব তথ্য এখন প্যানেলের কাছে রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে কানাডায় এসএনসি-লাভালিনে কর্মরত কর্মকর্তা রমেশ শাহ (কানাডিয়ান নাগরিক) পদ্মা সেতুর ঘুষের তালিকা তৈরি করেছেন । তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় এসএনসি-লাভালিন কর্মকর্তা রমেশ শাহ ও মো. ইসমাইল হোসেনকে গ্রেফতার করেছিল কানাডিয়ান পুলিশ। বর্তমানে তারা জামিনে মুক্ত আছেন। তাদের সঙ্গেও প্যানেলের যোগাযোগ হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেতে এসএনসি-লাভালিন অনিয়ম, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক থেকে কানাডা সরকারের কাছে একটি অভিযোগ জানানোর পর এ বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে। এরপর পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ওই অফিসের কম্পিউটারসহ সব ধরনের নথিপত্র জব্দ করে। জব্দ করা নথিপত্রের মধ্যে একটি ডায়েরিতে ঘুষ দেওয়ার জন্য তৈরি ওই তালিকা পাওয়া যায়।

প্যানেলের উপস্থিতিতেই মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদ!

বিশ্বব্যাংকের ৩ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের উপস্থিতিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হতে পারে ছুটিতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে। ড. মসিউর পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পদ্মাসেতু প্রকল্পে যে ক’জন সরকারি কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার শর্ত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপদেষ্টাও রয়েছেন।
এদিকে পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে আবুল হোসেন ছাড়া এ পর্যন্ত  হাইপ্রোফাইল যেসব ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক তাদেরমধ্যে রয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী এবং এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হক।

গত ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক ৩ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠনের ঘোষণা দেয়।   আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-আইসিসির সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোকে করা হয় এ টিমের প্রধান। তার নেতৃত্বে অপর দুই সদস্য হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। দুর্নীতি বিষয়ক অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে বিশ্বব্যাপী এদের খ্যাতি রয়েছে। তিনব্যক্তির এ বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদনের ওপর এখন নির্ভর করছে পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।