ঢাকা: পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে বাম ধারার আলোচিত দল দুটি।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনআমলের অবসানের পর ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম দুই শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের ওপরও ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় দল দুটি। দলের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর নেতাকর্মীরা কারো কাছ থেকে কোনো নির্দেশনাও পাচ্ছেন না।
একই অবস্থা জোটের অন্য শরিক দলগুলোরও। তবে ৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের নাম বিভিন্ন কারণে এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বার বার আলোচনা-সালোচনায় এলেও ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের অস্তিত্ব কোথাও নেই!
১৪ দলীয় জোটের দলগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু ওয়ার্কার্স পার্টি বা জাসদই নয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা মারাত্মক রাজনৈতিক সংকটে রয়েছেন। এই দলগুলো কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে পারছে না। দলের নেতাকর্মীরাও রাজনৈতিকভাবে রয়েছেন নিষ্ক্রিয় হয়ে। তাদের ব্যক্তি জীবনও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ নেতাকর্মী এখনও গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওই দিনই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর ওপরও বিপর্যয় নেমে আসে। ৬ মাসের বেশি সময় পার হলেও দলগুলোর নেতাকর্মীদের আতঙ্ক কাটছে না। দলগুলো স্থবির, নিষ্ক্রিয় থেকে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
এই দলগুলোর একাধিক সূত্র জানায়, নিজেদের রক্ষার জন্য এখনও নিরাপদে গা ঢাকা দিয়েই আছে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর অনেক নেতাকর্মী। সব সময়ই সাংগঠনিক শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী কমবেশি কর্মসূচি দিয়ে এই দলগুলো মাঠে থাকার চেষ্টা করলেও ৫ আগস্টের পর তাদের প্রকাশ্যে মাঠে দেখা যায়নি। এমনকি ঘরোয়াভাবেও কোনো কর্মসূচি দেওয়ার সাহস ও সুযোগ এখনও পাচ্ছে না দলগুলো। কেন্দ্র থেকে জেলা উপজেলা পর্যন্ত সবখানেই একই অবস্থা চলছে।
১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, তাদের মধ্যে সম্প্রতি আতঙ্ক আরও বেড়েছে। নতুন করে গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হওয়ায় এই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এই সব দলের নেতাকর্মীরা নজরদারির মধ্যেও রয়েছেন। দলের অফিসগুলোতে প্রতিনিয়ত নজরদারি চলছে। কেন্দ্র থেকে জেলা, উপজেলাসহ সারা দেশেই এই জোটের নেতাকর্মীদের একই অবস্থা। বিশেষ করে এই জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের নেতাকর্মীদের ওপর চাপ বেশি রয়েছে। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় এই দলগুলোর নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন মামলায় কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়াও যেসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে, কর্মীদের সেই সব মামলায় গ্রেপ্তার করা হতে পারে, এই ভয়ও জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মীদের মধ্যে কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে গা ঢাকা দিয়ে থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাসদের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, নতুন করে গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। যাদের নামে মামলা নেই এমন অনেক নেতাকর্মীও গ্রেপ্তারের ভয়ে আছেন। রাজনীতির কথা অনেকেই ভাবতে পারছেন না। কতদিন এভাবে চলতে হবে, সেটাও কেউ ধারণা করতে পারছেন না।
১৪ দলের আরেক শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর এক সদস্য বলেন, দল কোনো কর্মসূচি নিতে পারছে না বা প্রকাশ্য কোনো তৎপরতায় যাওয়া সম্ভব না। নেতাকর্মীরাও অধিকাংশই প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। প্রচণ্ড চাপে রয়েছে দলটির সব পর্যায়ের নেতাকর্মী। ১৪ দলের অন্য শরিক দলগুলোরও একই অবস্থা। ওইসব দলের নেতাকর্মীরাও সবাই কমবেশি সংকটে রয়েছেন। দলগুলোর নেতাকর্মী যারা রাজনীতিতে পরিচিত মুখ তারাও নিজেদের নিরাপদে রাখতে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তবে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের নেতাকর্মীরাই বেশি সংকটে রয়েছেন বলে জানান তিনি।
১৪ দলীয় জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ ছাড়াও দল রয়েছে ১১টি। দলগুলো হলো—ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), তরীকত ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও বাসদ (রেজাউর রশিদ)। শরিক দলগুলোর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদই ছিল রাজনীতির মাঠে সবর ও দৃশ্যমান। যদিও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠনের পর দল দুটির রাজনৈতিক তৎপরতা কমতে থাকে। সাংগঠনিক অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। তারপরও জোটের বাইরে থেকে নিজস্ব কিছু কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করেছে দল দুটি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সেই পরিস্থিতিও নেই। দল দুটির প্রধান নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ৫ আগস্টের কয়েক দিন পরই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামালা রয়েছে। অন্য নেতাকর্মীদের অনেকের নামে মামলা থাকায় তারাও সামনে আসতে পারছেন না। এতে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তি ভেঙে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দল দুটি রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের সাথে ১৪ দল গঠনের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশর ওয়ার্কার্স পার্টি। ১৪ দলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মতবিরোধে দলটি তিন দফা ভাঙ্গনের শিকার হয়। ওই সময় দলের নেতাকর্মীরা বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল গঠন ও অন্য দলে যোগ দেন। এ সময় কেউ কেউ সিপিবিতে যোগ দেন এবং কেউ কেউ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন। আবার কেউ কেউ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। এর মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হারায় দলটি।
একইভাবে ভাঙনের শিকার হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। দলটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা এবং কর্মীদের একটি বড় অংশ বেরিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ জাসদ নামে নতুন দল গঠন করে।
আওয়ামী লীগ সরকারের এক মেয়াদে মন্ত্রী হয়েছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এ ছাড়া গত চারটি সংসদে দল দুটি থেকে কয়েকজন করে এমপিও হয়েছিলেন। এই সময় দল দুটির কিছু নেতাকর্মী ব্যক্তি স্বার্থের দিকে ঝুঁকে পড়েন। দলকে ব্যবহার করে নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে তারা তৎপর থাকেন। এসব কারণে দল দুটির রাজনীতি ও সাংগঠনিক কাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দল দুটি একক নেতার উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে গ্রেপ্তার করে। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও দুর্নীতির মামলা রয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের শীর্ষ এই দুই নেতা কারাবন্দি থাকায় দল দুটিতে নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৫
এসকে/এমজেএফ